[প্রথমপাতা]

 

 

 

সুপ্রিম কোর্টের এই ভূমিকাই দেখতে চাই সবসময়

 
সৈয়দ বোরহান কবীর

 

আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু থেকে যে কথাটা আমরা প্রতিদিন বলে এসেছি, গত ২৬ আগস্ট ২০১০ তার স্বীকৃতি দিল সর্বোচ্চ আদালত। জিয়া এবং এরশাদ একই কায়দায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। সামরিক ফরমানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন, সংবিধানের কবর রচনা করেছিলেন। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এসব সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করল। কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। ৫ম সংশোধনীর ঐতিহাসিক রায়, ৭ম সংশোধনী সম্পর্কে হাইকোর্টের রায় ছাড়াও জনস্বার্থে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে আমাদের অধিকারের আধার সর্বোচ্চ আদালত। একটি দেশের গণতন্ত্র যত বেশি বিকশিত সেই দেশের বিচার বিভাগ ততটাই সংবিধান এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় দৃঢ় হয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, সুপ্রিমকোর্ট হলো জনগণের অধিকার ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। যখনই এ অধিকারের ওপর আঘাত আসে, তখনই আমরা এখনকার মতো সুপ্রিমকোর্টের সাহসী, কার্যকর ও যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত সময়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত কি সেই ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিল? আজ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আদালত যেভাবে স্বাধীন ও নির্ভার আইনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কাল আবার একটি অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সেই সাহস দেখানোর স্বক্ষমতা কি আমাদের বিচার বিভাগ অর্জন করেছে?

আজ সুপ্রিমকোর্ট স্কুলের পোশাক থেকে শুরু করে জাহাজভাঙার মতো পরিবেশবিনাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি নাগরিক সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এই অভিভাবকত্বই প্রত্যাশা করে। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কেন সুয়োমোটো (স্ব-প্রণোদিত হয়ে) কারণ দর্শায় নাই, কেন খুনি চক্রকে আদালতে হাজির করে বলেনি, তোমরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছ, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সায়েম সেদিন কোন কতর্ৃত্ব বলে রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন? এরশাদের সামরিক শাসন জারি আজ অবৈধ হয়েছে অথচ সেদিন বিচারপতি আহসানউদ্দিন অবৈধ শাসনের তল্পিবাহক রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে কি বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেননি? কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দেশের আইনজীবীদের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে কেন দীর্ঘদিন আদালত বর্জন করতে হয়েছিল?

আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের বিচারের নথি আদালতে তলব করা হয়েছে। অথচ কেন '৭৬-এ সর্বোচ্চ আদালত নীরবে মুখ বুজে প্রহসনের ফাঁসি দেখেছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে যখন হাজার হাজার জওয়ানকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছে তখন কেন সুপ্রিমকোর্ট দর্শকের মতো দাঁড়িয়েছিল? জিয়া হত্যার এক বানোয়াট মামলায় এরশাদ যখন বীর মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আদেশ দিল, তখন তাদের পরিবার ছুটে গিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল, সামরিক আদালত, তাদের কতৃত্ব-বহির্ভূত বিষয় বলে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার কাঙ্ক্ষিত, সংবিধান প্রদত্ত অভিভাবকের দায়িত্ব পালন না করায় সংবিধান লঙ্ঘনকারীরা আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করেছে, মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। আজ তারও নির্মোহ পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

এ কথা সত্য, অবরুদ্ধ সময়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত অনেক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। অষ্টম সংশোধনী সংক্রান্ত মামলা, খবরের কাগজ প্রকাশনার মামলা এখানে উলেস্নখ করার মতো। কিন্তু এখানে পুরো বিচার বিভাগ নয়, বরং কয়েকজন ব্যক্তি বিচারপতির বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতাই চোখে পড়েছে। কিন্তু আমরা চাই, একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা যা সংবিধানের রক্ষাকর্তা, আমাদের অধিকারের বু্যহ হিসেবে কাজ করবে।

আজ এত বছর পর জিয়া এরশাদের শাসন অবৈধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু লুৎফা তাহের কি ফিরে পাবেন, তার ৩৪ বছর? জেনারেল মঞ্জুরকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হলো, তিনি কি ফিরে পাবেন তার হারানো সম্মান? গাজী, সামিউলের মতো সৈনিকদের সন্তানরা কি ফিরে পাবে তাদের পিতাকে? কর্নেল নওশাদের ভালবাসা কি ফিরে আসবে তার স্ত্রীর কপালে? শহীদ ডা. মিলনের কন্যা কি আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে তার পিতার বুকে? জাফর, জয়নাল, দীপালী, কাঞ্চন কি আবার ফিরে আসবেন বিখ্যাত পলাশ ফোটা দিনে? কমরেড তাজুল কি আবার আদমজীতে শ্রমিকের জাগরণের মন্ত্র পড়াতে পারবেন? নূর হোসেন কি তার পুরান ঢাকার বাড়িতে ফিরে এসে উদোম শরীরে একটা শার্ট পরতে পারবেন? এরশাদের সামরিক শাসন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। ইলাস্টিকের মতো লম্বা হয়েছিল আমাদের শিক্ষাজীবন, আমাদের স্বপ্নগুলো চোখের সামনে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। কে আমাদের ফিরিয়ে দেবে হারানো সেইসব বছর?

আমরা সুপ্রিমকোর্টের এই ভূমিকাই দেখতে চাই সবসময়। বাংলাদেশে আর কখনো যেন উর্দিপরা ক্ষমতাবানরা এসে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর ধৃষ্টতা না দেখায়, আর যেন লঙ্ঘিত না হয় মানবাধিকার। শুধু আজ নয়, আগামীকাল এবং চিরকাল যেন আমরা সুপ্রিমকোর্টের এই ভূমিকাই পাই। তাহলেই গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির চির অবসান হবে এই বাংলাদেশে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com   
 

[প্রথমপাতা]