[প্রথমপাতা]

 

 

 

একজন মানুষ ফুল একজন নজরুল...

 


মোমিন মেহেদী

একটা মানুষ সবসময়-ই মানুষ ছিলেন তাই/ এই যে স্বদেশ স্বপ্ন সকাল স্মরণ করে যাই/ সেই মানুষের মত হওয়ার ইচ্ছে আমার আছে/ হবোই হবো অনেক বড় স্বপ্ন আমার কাছে/ এই স্বপ্ন সকাল বেলার পাখির যেমন থাকে/ এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে শিল্পী যেমন আঁকে/ তেমন করেই এগিয়ে যাবো বাংলাদেশের জন্য/ প্রয়োজনে নজরুলের-ই মত হবো ধন্য/ লিখে যাবো বলে যাবো বাংলা ভাষায় সত্যি/ তাড়িয়ে যাবো এদেশ থেকে শত্রু এবং দত্যি/ মনের ঘরে নজরুল আর রাজপথে তাই কাব্য/ আজন্মকাল এমনি করেই দেশকে নিয়ে ভাববো... লেখাটি একজন কবিকে নিয়ে। তিনি আমাদের জাতীয় কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি ছিলেন একাধারে কবি, ছড়াকার, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, ঔপন্যাসিক এবং রাজনীতিক। এছাড়াও ছিলো তাঁর অজ¯্র গুণ; যা যখন তখন তিনি উপস্থাপন করতেন। ছোট বেলায় আমাদের জাতীয় কবি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন এবং ওস্তাদজিও ছিলেন। এতগুণের অধিকারী প্রিয় এই কবি শৈশব থেকেই কষ্ট করে বেড়ে উঠেছিলেন। পিতৃহীন সংসারের হালও ধরেছিলেন তিনি। আর তাই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। কখনো লেটো গানের দলে গান গেয়ে, কখনো নাটকে অভিনয় করে আবার কখনো মসজিদে চাকুরী করে তিনি সংসার চালিয়েছেন। এত সংগ্রাম-এত জীবনযুদ্ধ করেও তিনি আমাদের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ। জীবনের নানা দ্বন্দ¡, সংঘাত ও পোড়নে তাঁর শৈশব। আট বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল শৈশবকে দেখেছিলেন অবর্ণনীয় লোনাজলে। পরপর চার সন্তানের মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম বিধায় তাঁর নাম রাখা হয় eদুখু মিয়াf। eদুখু মিয়াf নামটাই তাঁর পরবর্তী জীবনে সত্য হয়ে ধরা দিয়েছিলো। আটাত্তর বছর বেঁচেছিলেন নজরুল । এর মধ্যে ৩৪ বছরই ছিলেন বাঁকহারা। বাকি মাত্র চুয়াল্লিশ বছর সচল জীবনে নজরুল উপহার দিয়েছেন সৃষ্টির বিস্ময় eবিদ্রোহীf eঅগ্নিবীণাfসহ অসংখ্য গ্রন্থ; যা আমাদের বাংলা সাহিত্যতো বটেই বিশ্ব সাহিত্যেও সমাদৃত হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; কবিতা-গানের সাথে সাথে শিশুতোষ ছড়া-কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন বৈচিত্র প্রয়াসী। ছন্দের পরীক্ষা- নিরীক্ষা, নতুন বিষয় নির্বাচন, এমনকি শৈলী নির্মাণেও নজরুল নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছেন। নজরুলের শিশুকিশোর মাটিগন্ধি, সেই ক্ষেত থেকে উঠে আসা, সেই জলা থেকে উঠে আসা। তাঁর শিশুতোষ ছড়া কবিতায় শুধু শিশুদের কৌতূহল নয়, বরং তাদের বঞ্চনা, লাঞ্চনা ও উৎপীড়নের কথাও উঠে এসেছে। তাঁর বিখ্যাত শিশুতোষ ছড়ার বই eঝিঙেফুলf। মায়ের প্রতি তোমার, তোমাদের যেমন ভালোবাসা-ভালো লাগা; তেমন ভালোবাসা সবসময় ধারন করতেন নজরুলও। আর তাই মাকে নিয়ে লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, আমি হব সকাল বেলার পাখি/ সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি/ সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে/ eহয়নি সকাল ঘুমো এখনf মা-বলবেন রেগে। (খোকার সাধ, কাজী নজরুল ইসলাম)
এই যে স্বপ্নময় আগামী গড়ার শিক্ষা কেবল নজরুলের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। কেননা, তিনি ছিলেন নিরন্তর স্বপ্নগড়ার কারিগর। আর তাই মায়ের প্রতি নিগুঢ় ভালোবাসা-সম্মান থেকে তিনি লিখেছেন, মাগো! আমায় বলতে পারিস/ কোথায় ছিলাম আমি/ কোন-না জানা দেশ থেকে তোর কোলে এলাম নামি?/ আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি মেলে/ চাঁদকে বুঝি বলতিস/ -ঐ ঘরছাড়া মোর ছেলে?/ শুকতারাকে বলতিস কি আয়রে নেমে আয়/ তোর রূপ যে মায়ের কোলে বেশী শোভা পায় ( কোথায় ছিলাম আমি/কাজী নজরুল ইসলাম)
আমাদের রাতকে দিন করার জন্য নিজেকে কষ্টময় সময়ে রেখেও তিনি লিখে যেতেন সবটুকু দরদ দিয়ে। কেননা, তিনি ধারণা করতেন তার এই লেখা পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রত্যয়ী হবে। দেশ নিয়ে মানুষ নিয়ে ভাববে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হওয়ারও অনেক বছর আগে তিনি একবার রাজনৈতিক একটি দলের নেতা হিসেবে বলেছিলেন, eনিজের জন্য নয়; আমি আমার দেশ ও মানুষের জন্য রাজনীতি করি। আপনারা আমাকে কখনো গ্রহণ করলে মনে করবো আমি যোগ্য ছিলাম রাজনীতির জন্য।f না, তাকে কেউ গ্রহণ করেননি। নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হননি। তাতে কোন আক্ষেপ ছিলো না তাঁর। কমরেড মোজাফফর, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎতকালিন নিবেদিত সকল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তিনিও দেশের জন্য-মানুষের জন্য কাজ করেছেন। যে কারনে নজরুল একজন কবি হিসেবে বাংলাদেশের যেমন জাতীয় কবি; অন্যদিকে একজন নিবেদিত রাজনীতিক হিসেবেও ব্যাপক সমাদৃত। প্রকৃত মানুষ সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভাবে বলেই কথাগুলো বললাম। সে যাই হোক, কখনো কি তালগাছ দেখেছো, দূর আকাশের কাছাকাছি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ? এই তালগাছ নিয়ে কি দারুণ করে লিখেছেন নজরুল, দেখো- ঝাঁকরা চুলো তালগাছ, তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই/ আমার মতো পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই/ আমার মতো এক পায়ে ভাই
দাঁড়িয়ে আছিস্ কান ধরে ঠায়/ একটুখানি ঘুমোয় না তোর পন্ডিত মশাই? ( তালগাছ, কাজী নজরুল ইসলাম)।
নজরুল মানেই ডানপিটে স্বভাবের দূরন্ত কিশোর। যার কাছে স্বপ্নই বাস্তবতা। হয়তো একারনেই সবসময় আনন্দ আর হাসির জোয়ারে যেমন নিজে ভাসতেন, অন্যদেরকেও ভাসিয়ে রাখতেন। এমন নজরুল যুগে নয়, শত বছর নয়, হাজার বছরে একজন করে আসে এক একটি দেশে। সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একজনের মধ্যে তিনি অন্যতম। শ্রেষ্ঠ এই মানুষ কবি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও মাত্র চুয়াল্লিশ বছরে বাঁকশক্তি হারানোর কারনে অনেকটাই বিমূঢ় হয়ে যান। অথচ এই তিনিই তাঁর ভর কৈশোরের কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেনদ, বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে/ সে কি বাস করলে তাড়া/ বলি থাম একটু করি দাঁড়া .../ তবে মোর নামই মিছা!.../ কুকুরের চামড়া খিঁচা/ সে কি ভাই যায়রে ভুলা/ মালীর ঐ পিটনিগুলা/ কি বলিস? ফের হপ্তা/ তৌবা নাক খপ্তা॥ (লিচুচোর, কাজী নজরুল ইসলাম)।
তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সব বিষয়েই সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিবেদিত থাকতেন তিনি। যে কারনে দেখা যায় যে, কাজী নজরুলের ছড়াই হোক, আর কবিতা সবার চেয়ে ভিন্ন এবং জনপ্রিয়। যেমন কাঠবেড়ালি, এই লেখাটিতে তিনি ছোট্ট একটা বিষয় এমন ভাবে বলেছেন যে, জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রতিটি পঙতি...কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?/ গুঁড় মুড়ি খাও? দুধভাত খাও?/ বাতাবি নেবু? লাউ? বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?/ ডাইনি তুমি হোৎকা পেটুক?/ খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
(খুকি ও কাঠবিড়ালি, কাজী নজরুল ইসলাম)
একটা কাঠবিড়ালীকে কাজী নজরুল ইসলাম সবার ভালো লাগা এবং মনোযোগের স্থানে নিয়ে আসতে পারেন, তেমনি পারেন একটা ব্যাঙকেও কিশোরবেলার মজার বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করতে। আর তাই তিনি লিখেছেন, ও ভাই কোলাব্যাঙ ও ভাই কোলাব্যাঙ/ সর্দি তোমার হয় না বুঝি/ ও ভাই কোলা ব্যাঙ/ সারাটি দিন জল ঘেঁটে যাও/ ছড়িয়ে দুটি ঠ্যাঙ। (ও ভাই কোলাব্যাঙ, কাজী নজরুল ইসলাম)

তাঁর ছড়ায় রয়েছে বহুমাত্রিকতার ছাপ। বৈচিত্রতার রাস্তায় আমাদের জাতীয় কবি বহুদূর এগিয়েছিলেন, বিশেষ করে ছন্দ ও শৈলীতে। এই কারনে নতুন প্রজন্ম নিজেদেরকে সকাল বেলার পাখি ভাবে। তারা নিজেদেরকে কখনোই মেঘের কোলে হারিয়ে যাওয়া কোন দেও দানব ভাবে না। নজরুল ইসলাম নিজে যেমন নতুন আলোর মত ঝকঝকে ছিলেন, তেমন চাইতেনও যে সবাই-ই আলোকিত হয়ে থাক, আলোকিত হয়ে যাক। যে কারনে তিনি একদিকে সরাসরি শিক্ষণীয় লেখা যেমন লিখেছেন, অন্যদিকে ব্যাঙ্গ ছড়ার মাধ্যমে দিয়েছেন নেপথ্য জ্ঞানও। যেমন- ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়/ যাইতে যাইতে খ্যাঁচখ্যাচায়/ প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ/ কাওয়ারা সব লইল পাছ/ প্যাঁচার ভাইস্তা কোলাব্যাঙ/ কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং/ প্যাঁচায় কয় বাপ, বাড়িতে যাও/ পাছ লইছে সব হাপের ছাও/ ইঁদুর জবাই কইর‌্যা খায়/ বোঁচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়। (প্যাঁচা,কাজী নজরুল ইসলাম)
দ্দধু এখানেই শেষ নয়; তিনি হাসিরও রাজা প্রমাণ করেছেন এই ছড়াতে, মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়/ ক্রুদ্ব হয়ে যুদ্বে যায়/ বেঁটে খাটো নিটপিটে পায়/ ছেৎরে চলে কেৎরে চায়/ মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়। (মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম)

যদি প্রশ্ন করা হয় প্রিয় কবি কে? অনেকেরই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা কারও কারও কাছে নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশ প্রিয়। তবে ছোট্টবেলা থেকে কেন যেন নজরুল আমার প্রিয় কবি। নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহী প্রকাশ হয়তো তার কারণ হবে। যে কারনেই হোক তিনি আমার প্রধান প্রিয় কবি। এরপর কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, আল মুজাহিদী, কাজী রোজী, সুকুমার বড়–য়া, খালেদ হোসাইন, রাশেদ রউফ, শান্তা ফারজানাসহ অনেকেই রয়েছেন প্রিয় কবির তালিকায়। তবে বারবার মনে হয়েছে নজরুল যেমন আমার প্রিয়; তেমনি লক্ষ-কোটি বাঙালিরও প্রিয়তর তিনি। শৈশবে ভাল লাগা যে ছড়া কবিতাগুলো এখনো মাঝে মধ্যে প্রায়শই পাঠ করতে পেরে আনন্দ লাগে, তেমন কিছু ছড়া কবিতার কথা বলতে গেলেই প্রথমেই প্রভাতীর কথা বলতে হয়- ভোর হলো দোর খোলো/ খুকুমনি ওঠ রে!/ ঐ ডাকে জুঁই-শাখে/ ফুল-খুকী ছোট রে! (প্রভাতী, কাজী নজরুল ইসলাম)

আজ যখন নতুন করে দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধ করার সময় আসবে। দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়তে হবে। তখন নতুন প্রজন্ম যেন নজরুলের কবিতার মধ্যে যে স্বপ্নময় আগামীর কথা আছে, সে আগামীর জন্য নিবেদিত হয়। এমন প্রত্যাশা সকাল বেলার পাখি হতে চাওয়া একজন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমি যেমন ভাবি, সেই ভাবনা সবার মধ্যে বিরাজ করুক; এমন প্রত্যাশা সবসময় আমাদের সকলের জন্য। পরিশেষে তা্ওঁ জন্য নিবেদিত কয়েক পঙতি। যার কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা আলোর স্বপ্ন দেখতে শিখেছি- এই যে আকাশ স্বপ্ন ভরা নীল/ তোমার সাথে অনেক অনেক মিল/ কারন নজরুল আকাশ ছিলে উদার ছিলো মন/ তোমার মত তৈরি হওয়ার জন্য সারাক্ষণ-/ বই পড়ি আর জীবন গড়ি যুদ্ধ শিখি কলমে/ দেশের ওসুখ সারাতে চাই লেখালেখির মলমে...

মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.  

[প্রথমপাতা]