@

[প্রথমপাতা]

@

@

ওবামার টোকিও ভাষণ 

কাজী ইনসান


এই সময় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি কে? উত্তরের জন্য সম্প্রতি প্রকাশিত ফোবর্স-এর জরিপের রেফারেন্স না দিয়েই যে কেউ একবাক্যে যে নামটি উচ্চারণ করবে সেটি হচ্ছেন, ওবামা, বারাক হোসেন ওবামা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি এখন টোকিওতে। প্রথম ৮ দিনব্যাপী এশিয়া সফরে সূচনা করেছেন টোকিও দিয়ে। গত সন্ধ্যায় তিনি এসেছেন। জাপান থেকে আজকেই বিদায় নেবেন সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে। টেকসাসের মিলিটারি বেজে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শোকসভায় যোগ দিতে তিনি জাপান সফর একদিন পিছিয়ে দিয়েছিলেন।

১২ নভেম্বর জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জরুরি নির্দেশ। ১৪ তারিখ সকালে His Excellency Mr. Barak H. Obama-র Policy Speace- এর প্রেস কভারেজে আমি যাব কিনা? কোনো কিছু ভাববার আগেই জানিয়ে দিলাম eযাবf। বলা হলো এখনই Fax-এ পাঠানো হচ্ছে Reply করুন। ৪০ জন বিদেশি সাংবাদিক এই সুযোগ পাবে। কেবল মাত্র Pen সাংবাদিক, Camera সাংবাদিকের সুযোগ নেই। আপনার পাঠানো Fax-এর আগেই যদি ৪০ জনের কোটা পূরণ হয়ে যায় তাহলে Sorry। Fax পাঠানোর ৫ মিনিট পরেই Confirmed আপনি Selected। এর পর নিরাপত্তাজনিত নানান বয়ান। বড় ক্যামেরায় ছবি নিতে পারবেন না, ছোট ক্যামেরায় দুবারের বেশি নয়, No flash। জাপানের নিরাপত্তা বিভাগ তোমার Allien card আর প্রেস এক্রিডিটেশন কার্ড দেখবে। কিন্তু আমেরিকান সিকিউরিটি কি চাইবে তা আমাদের জানা নেই। পাসপোর্ট, আমেরিকা ভ্রমণ করলে সে ভিসা ইত্যাদি চাইতে পারেন তাই সব প্রস্তুতি নিয়ে আসাই ভালো।

জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদিত এবং ফরেন প্রেস কার্ড হোল্ডার বাংলাদেশের আমরা তিনজন। দুজন Pen Journalist মনজুরুল হক ও আমি আর Camera Journalist, DRIK JAPAN-এর বন্ধু খন্দকার আনিসুর রহমান। মনজুরুল হক বর্তমানে ফরেন প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় আমন্ত্রিত। আনিসকে ফোন করলাম, সে Apply করেছে তবে জবাব আসেনি। তবে বিদেশি প্রেসক্লাবের নিয়মিত সদস্য হিসেবে তার সুযোগ আছে। ভেন্যু SUNTORY Hall, মর্যাদাবান এই হলটি আকাসাকায়, মূলত বড় কনসার্ট-এ ব্যবহৃত হয়। দশটায় ভাষণ শুরু। সাড়ে নয়টার মধ্যে নিজ আসনে বসতে হবে। হলের সামনে বেশ ভিড়, শত শত ক্যামেরা, পথের দুপাশে কৌতূহলী জনসমাগম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, না বারাক ওবামা এ পথে আসবেন না, কোন পথে আসবেন সেটাও কেউ জানে না। সবকিছুই হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। ভিড়ের কারণ জাপানের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক ও জাপানের নামকরা লোকরা আসছেন তাদের দেখতেই এই ভিড়।

হাতব্যাগ, পার্স, কলম, চশমা, মোবাইল, কয়েন, জুতাসহ টুকিটাকি সব বক্সে রেখে নিজেকে মেশিনে ঢুকিয়ে, জাপানি পুলিশের তল্লাশি ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালদেহী আমেরিকান সিকিউরিটির মিটি মিটি চোখের Clearence নিয়ে, নিজের জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে, জুতা পরতে পরতে White House Press Pool-এর একটি কার্ডে আসন নম্বর নিয়ে হলে ঢুকলাম। দর্শকসারির প্রথম ব্লকে প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক ও বিশেষ মর্যাদাবান ব্যক্তিদের আসন। দ্বিতীয় থেকে আমরা। প্রায় ৫০০ সিটের মধ্যে আমরা বোধকরি তখনো ৩০ জন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি ও আমেরিকার নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন ইতিউতি হাঁটাহাঁটি করছেন। তবে উপরে-ডানে, বাঁয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। প্রায় ১৫০০ দর্শক অপেক্ষা করছেন সেই মহেন্দ্রক্ষণের।

বন্ধু আনিসের ডাকে পেছনে তাকালাম। eএত পেছনে কেন?f প্রশ্ন করেই বকুনি খেলাম অভিজ্ঞ ক্যামেরাম্যান আনিসের। eসামনে টিভি ক্যামেরার লাইন দেখছেন? ওরা যখন দাঁড়াবে সামনে ওদের পেছন ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। এই প্লেসটা সবচেয়ে ভালো। ইতোমধ্যেই আনিস তার সামনের NHK ক্যামেরাম্যানকে পর্যবেক্ষণ করে এসে জানাল ভদ্রলোক ছোটখাটো, দাঁড়ালেও অসুবিধা নেই।

আনিসের এই observation যে কতটা সত্য তা বারাক ওবামার ৪০ মিনিটের ভাষণের পুরো সময়টা অনুধাবন করেছি। আমরা আর ওবামা, মাঝখানে কোনো বাধা নেই। যেন উনি আমাদের দেখেই ভাষণ দিচ্ছেন (?) ছবি তোলা, টেপে ধারণ, বন্ধুদের ফোন করে ভাষণ শোনানো সব চলল এক সঙ্গে।
মঞ্চ সাজানো হয়েছে জাপান ও আমেরিকার পতাকা দিয়ে পেছনে নীল পর্দা, মাঝখানে ডায়াস। নির্দিষ্ট সময়ের ৫ মিনিট আগে দুজন আমেরিকান এসে ডায়াসের সামনে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল প্রতিকৃতি লাগিয়ে ওবামার উচ্চতায় মাইকের অবস্থান স্থির করলেন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বিরাট দুজন বডি গার্ড মঞ্চ দিয়ে এসে দুদিকের সিঁড়ি দিয়ে দর্শকদের দিকে মুখ করে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। সদাহাস্য ওবামা হাসতে হাসতে তার চিরচেনা হাঁটার স্টাইলে মঞ্চে এলেন। কলতানে মুখরিত গোটা হল। ছবি তোলার হিড়িক, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সবাই, অতিথিদের ক্যামেরা আর মোবাইলে ফ্লাশ জ্বলে উঠল। দীর্ঘ হাততালি দিয়ে হল ভর্তি ১৫০০ দর্শক ওবামাকে স্বাগত জানালেন।

Thank you so much. Arigalou, thank you very much. Good Morning. It is a great honor to be in Tokyo, the first stop of my visit to Asia as President of United States of America.

সাবলীল আর কৌতুকমিশ্রিত তার ভাষণের শুরুতে এবং অতি সিরিয়াস অধ্যায়ে সবখানেই সমবেত শ্রোতাদের করতালি। পিনপতন নিস্তব্ধতায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার পলিসি, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ও করণীয় বিষয়ক সুস্পষ্ট বক্তব্য দিলেন। কোনো ঘড়ঃব নয়, কোনো চধঢ়বৎ নয়, একনাগাড়ে অনর্গল একটিবারও কোনো ভুল নয়, রিপিট নয়। দর্শক বিমোহিত, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য শুনছেন, কানে লাগানো রিসিভারে জাপানি অনুবাদ শুনে সবাই ছন্দে ছন্দে তালি দিয়েই চলছেন। মনে পড়ল ৪ জুন ২০০৯ কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রতি ওবামার সেই বিখ্যাত ভাষণটির কথা। সেই ভাষণটি ছিল মুসলিম বিশ্বের প্রতি আর আজকের ভাষণটি যেন বাকি বিশ্বের প্রতি।

নিজেকে American First Pacific President হিসেবে উল্লেখ করে এশিয়ার সঙ্গে প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি তার স্মৃতিচারণ করলেন। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে কামাকুরা ভ্রমণের উল্লেখ করে কামাকুরার সেই বিখ্যাত বৌদ্ধমূর্তির স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। স্মৃতিতে ঐ বৌদ্ধমূর্তিতে শতবর্ষের ঐতিহ্যের চেয়ে ওই বয়সে আমার eমাসা আইসক্রিমf আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ গতরাতের ডিনারে উনি আমার জন্য নানান স্বাদের আইসক্রিমের জোগান দিয়েছেন। আমার জন্ম হাওয়াই, শৈশবে কিছুদিন ইন্দোনেশিয়ায় ছিলাম, জাকার্তায় আমার বোনের জন্ম, ওর বিয়ে হয়েছে একজন চাইনিজ কানাডিয়ানের সঙ্গে। আমার মা দীর্ঘ এক যুগ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি গ্রামে গরিব মেয়েদের নিয়ে কাজ করেছেন। এশিয়ার সঙ্গে আমার এই অভিজ্ঞতা হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিয়েছে। জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গত অর্ধশতাব্দি ধরে। পরস্পরের প্রতি সম্মান ও নিজেদের দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আমরা জাপানের নবনির্বাচিত সরকারের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তার প্রতি সমর্থন জানাই। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের সঙ্গে যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জাপানি উদ্যোগ তাতে আমেরিকাকেও পাশে রাখুন।

জাপানে বর্তমান সরকারকে ওবামার বিখ্যাত eChangef-এর ধারাবাহিক প্রবাহে জাপানি জনগণ নির্বাচিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কম নির্ভরতার কথা বলেই জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইউকিয়ো হাতোয়ামা জনগণের ম্যান্ডেড পেয়েছেন। ওকিনাওয়ার eফুতেনামাf ঘাঁটি নিয়ে ইতোমধ্যেই মন কষাকষি চলছে। আমেরিকাবিরোধী স্লোগান আর ডেমনস্ট্রশনও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বলেন দুfদেশে টাস্কফোর্স এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবে। যে সিদ্ধান্তই হবে সেটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। মানবাধিকার লংঘনের জন্য কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে তিনি চিনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলেন। চিনের উত্থানকে তিনি স্বাগত জানান। যে কোনো রাষ্ট্রের সাফল্যকে অভিনন্দন করা উচিত অতীতের সব সংকীর্ণতা থেকে সৌহার্দ্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে সম্পর্কের উন্নয়ন করাই শ্রেয়। বার্মা, উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে কথা বলতেও তিনি ewith due respectf বাক্যটি ব্যবহার করেন। সুকির মুক্তির আহ্বান জানান।

উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ক সংঘাত ও উস্কানি থেকে বিরত থেকে ছয় পক্ষীয় আলোচনায় ফিরে আসতে তিনি পিয়ংইয়ংকে অনুরোধ জানান। দক্ষিণ কোরিয়া কর্তৃক জাপানিদের অপহৃতের বিষয়ে তার দৃঢ়তার কথা বলায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফেরত আসা জাপানিরা খুশি। সন্তানহারা শিশু (shiguo huka) ইজুকা, Chairman of the Association of the families of Victims kidnapped by North Korea প্রথম সারিতে বসে ওবামার ভাষণ শোনেন, তার কান্নার শব্দ ওবামা লক্ষ্য করেন যদিও দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি।

ওবামা শহর থেকে এসেছেন ওবামা শহরের প্রতিনিধি। কথা হলো এই গ্রুপের প্রধান সেইজি ফুজিহারার সঙ্গে। eআমরা বারাক ওবামাকে আমাদের ওবামা শহরে নিয়ে যেতে পারবে না সেটা আমরা জানি, নিরাপত্তাজনিত কারণে আদৌ দেখা হবে কি না সেটাও অজানা। তবে তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন আমরা আফ্রিকান দূতাবাসের সামনে ঐতিহ্যবাহী হাওয়াই নাচ eহুলাf প্রদর্শন করেছি, আজও তার যাওয়ার পথে আবারও নাচের আয়োজন আছে। eহাওয়াই-এ তার শৈশবকাল ও একজন কেনিয়ান পিতার সন্তান হিসেবে আমরা এই নাচ ও নাচের স্থান নির্বাচন করেছি। আমরা অভিভূত একটু আগেই ওবামা তার ভাষণের শুরুতে ওবামা শহরের ৩০ হাজার অধিবাসীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, বলেছেন আমি আমেরিকার ওবামা জাপানির ওবামার কাছে যেতে না পারায় দুঃখিত।f

এশিয়া সফরে স্বামীর সঙ্গে আসার সুযোগ হয়নি ফার্স্টলেডি মিশেলা ওবামার। ওবামার Spokeman জানান, ওয়াশিংটনের একটি প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী দুই কন্যা মালিয়া ও শাসাকে সময় দেয়াকে তিনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। দীর্ঘ ৪০ মিনিটের ভাষণের ৩০ মিনিট জুড়েই ছিল Asian Policy বিষয়ক বক্তব্য। ভাষণের শেষে তিনি বলেন...

As American first Pacific President Promise you that this Pacific nation will strengthen and sustain our leadership in this vitally Important Part of the world.
Thank you very much.

বিদায় পর্বে তিনি স্টেজের সামনে, ডানে-বাঁয়ে উপরে সবদিকে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে হলভর্তি দর্শকও তাকে বিদায় জানালেন। আমরাও বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা কৌতুক করে সহযোগীকে বললেন, eওবামা সান নো এগো ওমাই দেস নে।f (ওবামা তো ভালোই ইংরেজি বলে?) জাপানিরা কখনো ইংরেজি বললে সহকর্মীরা তাকে উৎসাহিত করতে এ কথাটাই বলে। ধারে কাছে যারা ছিলেন সবাই এই উপস্থিত কৌতুকটি উপভোগ করলেন। ভিনি ভিডি ভিসি এভাবেই যেন বলা যায়। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।
এবার ফেরবার পালা।

@

[প্রথমপাতা]

@