@

[প্রথমপাতা]

@

@

এক্সক্লুসিভঃ কমিউনিটির সাথে বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেলের একান্ত সাক্ষাৎকার
@

জাপান ঘুরে গেলেন দেশ বরেণ্য চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে একটি ফেলোশীপ নিয়ে এবারে তার আগমন। এরই মাঝে হয়ে গেল তার বেশ কয়েকটি চিত্রপ্রদর্শনীও। ব্যাস্ততার মাঝেও জনাব তানভীর মোকাম্মেল মুখোমুখি হয়েছিলেন কমিউনিটির সাথে। তার এই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাতকারটি এখানে তুলে ধরা হলোঃ

প্রশ্ন : জাপানে এ নিয়ে কতবার এলেন?

উত্তর : এবার নিয়ে তিনবার জাপানে এসেছি।

প্রশ্ন : কীভাবে আপনার চলচ্চিত্রে আগমন?

উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন করতাম। চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াস পড়াশোনা, লেখালিখি, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করতাম। একসময়ে মনে হোল হাতেকলমে চলচ্চিত্র বানাতে পারলে ভাল হোত। তখন আমি eহুলিয়াf কবিতাটির চলচ্চিত্রায়ণ করে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করি। এভাবেই আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু।

প্রশ্ন : চলচ্চিত্রে আসতে গিয়ে কোনো প্রকার সামাজিক বা অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন?

উত্তর : উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। তবে আমি যে ধরণের ছবি তৈরী করতে চাই, সে ধরণের শিল্পসম্মত ছবি নির্মাণে আর্থিক সঙ্কটটা সবসময়ই আমাদের জন্যে একটা বড় সমস্যা।

প্রশ্ন : জাপানে এবার কী উদ্দেশ্যে এসেছেন?

উত্তর : এসেছি জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে। ওঁদের ভাষায় এশীয় লীডারশিপ ফেলো প্রোগ্রামে। ওঁদের নিমন্ত্রণের উদ্দেশ্য জাপানের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আমার আরো পরিচয় ঘটানো।

প্রশ্ন : এবারে জাপানে কতদিন থাকছেন?

উত্তর : সব মিলিয়ে দুfমাস।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জাপানীদের কেমন ধারণা?

উত্তর : খুব বেশী ধারণা এদের নেই। তবে আমার ছবিগুলির প্রদর্শনীতে বেশ কিছু জাপানী এসেছিলেন। তাদের অনেকেই জীবনে এই-ই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ছবি দেখলেন। মনে হোল ওদের তো ভালই লেগেছে।

প্রশ্ন : আমাদের সংস্কৃতির ছবি জাপানীরা কীভাবে গ্রহণ করছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : পৃথিবীর সব দেশের মানুষের গভীর সমস্যাগুলো মূলত: কিন্তু এক। সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে প্রকাশভঙ্গিমায় পার্থক্য থাকলেও প্রেম, যুদ্ধ, দুঃখ, আনন্দ, জীবনের এসব অনুভূতির ক্ষেত্রে এক দেশের মানুষের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু আমার ছবিতে মানুষের এসব মানবিক দিকগুলো থাকে, ফলে মনে হয় না আমার eরাবেয়াf বা eলালনf ছবি বুঝতে এদের কোনো সমস্যা হয়েছে। আর প্রামাণ্যচিত্রগুলো যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক হয়ে থাকে যেমন eকর্ণফুলীর কান্নাf পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে, eবনযাত্রীf সুন্দরবন নিয়ে বা eবস্ত্রবালিকারাf গার্মেন্টের নারীশ্রমিকদের নিয়ে, আমার মনে হয় না এসব ছবি বুঝতে জাপানীদের কোনোরকম সমস্যা ঘটেছে।

প্রশ্ন : জাপানের কোথায় কোথায় ঘুরেছেন?

উত্তর : টোকিও এত বড় শহর যে ঠিকমতো এ শহরের সবকিছু দেখতে-জানতেই বেশ সময় লেগে যায়। টোকিও ছাড়াও আমি আগে হিরোশিমা, নাগাসাকি, ফুকুওকা ও ইয়োকোহামাতে গিয়েছি। এবারে গেলাম রোক্কাশো পারমাণবিক কেন্দ্র দেখতে। তাছাড়া তাকাহাতার গ্রামে কৃষকদের মাঝে থেকেছি এবং হোক্কাইডোর কাছে উত্তর হনশুর গ্রামাঞ্চলে ও পাহাড়ে পাহাড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি।

প্রশ্ন : একজন সফল পরিচালকের অর্ন্তদৃষ্টিতে জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলের জীবনাচরণে কোনো স্বাতন্ত্র্য কী লক্ষ্য করেছেন? কোথাও কী আমাদের দেশের সাথে মিল দেখতে পেয়েছেন?

উত্তর : জাপানের খুবই নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। দীর্ঘদিন অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে জাপানের সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে যা একান্তই জাপানী এবং যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সংস্কৃতিতে নেই। যেমন এদের eকাবুকীf ও eনোহ্f নাটক, সুমো কুস্তি, ফুল ও খাবার সাজানোর চমৎকার নিজস্ব পদ্ধতি। তাছাড়া জাপানীদের ঘরবাড়ি তৈরীর একান্ত নিজস্ব গৃহসামগ্রী, কাপড়ের উজ্জ্বল প্রিন্ট ও বাঁশের সূক্ষ নানা কাজ, এসব আমাকে মুগ্ধ করেছে। টোকিও বা জাপানের অন্যান্য বড় শহরের বাইরে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ঘুরলে বোঝা যায় যে জাপানের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অনেক কিছুই এখনও বজায় রয়েছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সংস্কৃতির কিছু মিল তো রয়েছেই। এরা ভাত খেতে পছন্দ করে, আমরাও। বাঁশ ও কাঠের এদের নানা কাজের মতো কিছু ঐতিহ্য আমাদেরও ছিল যা অবশ্য দুঃখজনকভাবে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। আর জাপানীদের যা সবচে ভাল লেগেছে, তা হচ্ছে এদের কর্মসংস্কৃতি। আমরা বাঙ্গালীরা কথা-বেশী-বলি, কাজ-কম-করি, জাপানীরা সম্পূর্ণই তার বিপরীত। তাছাড়া এদের বিনয় ও ভদ্রতাবোধ খুবই উচ্চ প্রশংসার দাবী রাখে।

প্রশ্ন : নিজের কাজগুলোর মধ্যে কোনটিকে সেরা বলে মনে করেন?

উত্তর : নিজের কাজের মূল্যায়ণ নিজে ঠিকমতো করা যায় না। কারণ প্রত্যেকটা ছবির সঙ্গেই অনেক স্মৃতি, নানারকম আবেগ জড়িয়ে থাকে। আপনি যেমন কোনো মাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না যে তার অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে কোন্জন সবচে প্রিয়! কারণ একজন মায়ের কাছে তার সব সন্তানই প্রিয়।

তবে যদি খুব নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ণ করার চেষ্টা করি তবে বলব যে আমার কিছু ছবি, যেমন eচিত্রা নদীর পারেf বা eলালনf এবং কিছু প্রামাণ্যচিত্র eঅচিন পাখীf, eকর্ণফুলীর কান্নাf, eঅয়ি যমুনাf বা eনিঃসঙ্গ সারথিf হয়তো সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছে।

প্রশ্ন : নতুন নির্মাতাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ?

উত্তর : বাংলাদেশে গভীর সামাজিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নতুন পরিচালক তেমন নেই। তরুণদের অনেকের মধ্যে বাণিজ্যমুখী প্রবণতা প্রবল। শিল্পসম্মত ছবি তৈরীর জন্যে যে মেধা ও ত্যাগের প্রয়োজন তার ঘাটতি আছে। তাছাড়া সম্প্রতি মিডিয়ার ব্যাপক বিকাশের ফলে, মিডিয়ার অতিরিক্ত প্রচার-প্রচারণা তাদের বিকাশের পক্ষে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রশ্ন : তরুণ পরিচালকদের প্রতি আপনার কী উপদেশ?

উত্তর : চলচ্চিত্র সম্পর্কে আরো পঠন-পাঠন করা। বলিউডী ছবির জগৎ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে দেশবিদেশের ধ্রুপদী ছবি আরো বেশী করে দেখা। এছাড়া স্বদেশ ও সমাজকে আরো ভালো করে জানাটা জরুরী। কারণ আমার দেশের মাটি ও মানুষই আমাদের শিল্পের উপাদান ও লক্ষ্য।

প্রশ্ন : প্রবাসীদের অনেকেই ছবি নির্মাণ করতে চান, পুঁজি বিনিয়োগ করতে চান, কিন্তু তাদের অনেকেরই ধারণা নেই কী করে এগুবেনÑ তাদের প্রতি আপনার কী উপদেশ?

উত্তর : যারা পুঁজি লগ্নী করে কেবল মুনাফা করতে চান তাদেরকে সঠিক উপদেশ দেওয়ার যোগ্য লোক আমি নই। কারণ আমি নিজে ঠিক ওই জগতের মানুষ নই। তবে যারা সত্যিকারের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রে লগ্নি করতে চান তাঁদেরকে দেখতে হবে ওই পরিচালক আগে কী কী ভালো ছবি তৈরী করেছেন। উনি আদৌ ভালো ছবি বানাতে জানেন কী-না! তাছাড়া, ওই পরিচালকটি মানুষ হিসেবে কেমন সেটাও দেখা জরুরী। কারণ আমি জানি, চলচ্চিত্র ও মিডিয়ার জগতে অনেক চালবাজ ও টাউট-বাটপাড় ধরণের লোকজন রয়েছে। প্রবাসীদের উচিৎ ভালো মতো খোঁজ খবর নিয়েই কেবল অর্থ লগ্নী করা।

প্রশ্ন : বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কি আপনার চোখে পড়েছে?

উত্তর : সবার মধ্যেই লক্ষ্য করেছি দেশের প্রতি এক গভীর টান ও মমতা। হয়তো প্রবাসে থাকেন বলেই এই মমতাবোধটা খুবই প্রবল ও আন্তরিক। এটা খুবই চোখে পড়ার মতো একটা ব্যাপার যা আমার খুব ভাল লেগেছে।

এরই সাথে শেষ হয় আমাদের সাক্ষাৎকার পর্বটি। ভাল থাকুন তানভীর মোকাম্মেল, আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরো সমৃদ্ধ করুন তার আরো অসংখ্য চলচ্চিত্র দিয়ে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

@

[প্রথমপাতা]