[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

নীরো কি সত্যি বাঁশী বাজাচ্ছিল?

 

 

- বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, হল্যান্ড থেকে

রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন- এমন একটা কথা বেশ প্রচলিত। ইতিহাসে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ তর্ক-বিতর্ক রয়ে গেছে। অনেকে যখন নীরোকে দোষারূপ করেছিল তার নীরব দর্শকের ভূমিকার জন্যে, অন্যদিকে অই অপবাদকে মিথ্যে বলে কেউ কেউ এও দাবি করেছিল যে নীরো ঘটনার পর পর ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে অই ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন ও চোখ ধাঁধানো রোম নগর সৃষ্টি করেছিলেন। নীরোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আগুন যে লেগেছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। ৬৪ সালের ১৮ জুলাই তারিখে সংঘটিত অই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রোম নগরীর ১৪ জেলার মাত্র ৪ জেলা রক্ষা পায় এবং বাকীগুলো পরিণত হয় আক্ষরিক অর্থে ধ্বংস্তূপে। ছয় দিনের অই অগ্নিকাণ্ডের পরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। তাতে ছিল নীরোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। সে প্রসংগে আসছি একটু পর। আগুন লাগার পর পর গুজব ছড়িয়ে যায় যে সম্রাট নীরো পেলেটাইনের চূড়ায় বসে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন এবং তার আশপাশ যখন আগুন দাউ দাউ করে গোটা নগর গ্রাস করেছিল তখন তিনি বাঁশীতে ‘স্যাক অব ইলিয়াম’-এর সুর তুলছিলেন। এ অভিযোগ বাতিল করে ভিন্ন ইতিহাসবিদ (টাসিটাস) বলেন, নীরো সে সময় ‘এনটিয়ামে’ ছিলেন এবং বাঁশী যে বাজাচ্ছিলেন তা কেবল গুজব। টাসিটাসের মতে, এই ঘটনার পর নীরো কোন নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াই দৌড়ে যান ঘটনাস্থলে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে লেগে পড়েন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তার প্রাসাদে আশ্রয়ও দেন। এর পর তিনি নতুন ‘আরবান প্ল্যান’ তৈরি করেন এবং ভগ্নস্তূপের ওপর গড়ে তুলেন নতুন আধুনিক রোম নগর।
কদিন আগে রোম ঘুরে এলাম। প্রতিবারের মতই এবারও কাজ নিয়ে যাওয়া। এর আগে এই শহরে আরো দুবার ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছে। কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় হাতে পেয়েছি দেখার চেষ্টা করেছি ইতিহাসে নানা কারণে উল্লেখিত ও বিখ্যাত এই নগরীকে। রোম শহরের বিশাল সড়ক, বিশালাকৃত ভবন চোখে পড়ার মত। মজার ব্যাপার হলো আজ রোম বিশ্বের খৃষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ‘মক্কা’ হলেও এ শহরেই আগুন লাগানোর অজুহাতে নিষ্ঠুরভাবে খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করেন নীরো। নীরো মূলতঃ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আগুন লাগানোর অভিযোগ আনেন এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের ওপর। তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে অমানুসিক অত্যাচারের মুখে বাধ্য করেন আগুন লাগিয়েছে বলে স্বীকার করতে। এর পর শুরু হয় নীরোর নৃশংস অত্যাচার। খৃষ্টানদের ধরে এনে হিংস্র পশুর মুখে তুলে দিয়ে হত্যা করার মত ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি। সেই রোম নগরীর ঠিক মধ্যিখানে এখন ‘ভ্যাটিকান সিটি’। রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র।
ভ্যাটিকান সিটিতে যাবার সুযোগ- সময় কখনোই হয়ে উঠেনি। এবারের তিন দিনের রোম অবস্থানের শেষের দিন স্নেহভাজন রাজু বললো, ভ্যাটিকানে যাওয়া যায়। বিকেলে ফ্লাইট। হাতে বেশ ক’ঘন্টা সময়। তার ওপর রাজুর রয়েছে চার চাকার বাহন। হোটেল থেকে আধ ঘন্টারও কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্যাটিকান সিটিতে। যাবার আগে বিখ্যাত রোমান আর্কিটেকচারের নিদর্শন ‘ক্লজিয়াম’ ঘুরে গেলাম। কংক্রীট ও পাথরের তৈরি এই বিশাল থিয়েটারে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) দর্শকের বসার স্থান ছিল ৭২-৮০ সালে নির্মিত এই ‘ফ্লাভিয়ান এমফিথিয়েটার’। এবারও এর ভেতরে যাওয়া হয়নি। সময় বরাবরের মত বৈরী। কেবল বাইর থেকে দেখে কয়েকটা ছবি তোলা। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ পর্যটককে কাছে টেনে আনে এই ক্লজিয়াম। আজ এই ঐতিহাসিক স্থানটি ‘মৃত্যুদণ্ডের’ বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত। বিশ্বে কোন দেশে যেদিন কোন ব্যক্তির, কোন কারণে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বা রহিত করা হয় সে দিন এই ক্লজিয়ামের আলো সাদা থেকে সোনালী রং এ পরিবর্তন করা হয়। অতীতে গ্লাডিয়েটররা এই ক্লজিয়াম ব্যবহার করতো তাদের বীরত্ব দেখাতে। গ্লাডিয়েটররা আজ আর নেই কিন্তু ক্লজিয়াম এলে এর আশ-পাশে দেখবেন একই ধাঁচের পোশাক ও নকল অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নকল গ্লাডিয়েটররা। তারা আপনাকে আহবান জানাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বা কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুলতে। ছবি তোলার আগে কিন্তু দরদাম করে নেবেন, তা না হলে কপালে দুর্ভোগ আছে সে বলে রাখি।
ক্লজিয়াম ফেলে তখন ভ্যাটিকান সিটিতে পৌঁছি তখন দুপুর প্রায় সাড়ে বারটা। দূর থেকে এর বিশালত্ব দেখে অবাক হই। এতদিন কেবল টিভি পর্দায় দেখেছি সাদা পোশাকে আচ্ছাদিত একটি বৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুজ্ব, বুলেট প্রুফ গাড়ি করে এগিয়ে চলেছেন, তার দুপাশে নিরাপত্তা প্রহরী, তারাও গাড়ির সাথে সাথে দৌঁড়িয়ে চলেছেন। তাদের ছাড়িয়ে লাখো ভক্তকুল। দূরে থেকে চোখে পড়ে পোপের আবাসস্থল। সামনে বিশাল উন্মুক্ত স্থান। দর্শকের দীর্ঘ সারি। ভেতরে যাবার। কাছে যেতে চোখে পড়ে ভ্যাটিকানের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী। এই এলাকার বাইরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ইতালী সরকার। ১১০ একর এলাকা ও মাত্র ৮০০ অধিবাসী নিয়ে আয়তনে ও জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র এই ভ্যাটিকান সিটি। ভ্যাটিকান সিটি হলো বহুল পরিচিত ও আলোচিত একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র যা জাতিসংঘের সদস্য নয়। তবে এর রয়েছে স্থায়ী ‘অবজারভার’ স্ট্যাটাস। বেশ কিছু সময় কাটানোর পর ফিরে এলাম গাড়িতে। ফেরার তাড়া। প্রথমে এক বাঙালি হোটেল। মজার ব্যাপার হলো, ইতালী ইউরোপ হলেও মনে হয় এদেশে বসবাসরত বাঙালিয়া বাংলাদেশে রয়েছে। এখনো দুপুরে প্রায় সবাই (পরিচিত জনরা) ভরাপেট ভাত খায়, মজার তরকারি মাছ, মাংস দিয়ে। রাতে তো বটেই। দুপুরে যে হোটেলে খেতে বসেছি লক্ষ্য করি আমাদের পেছনে কয়েক সাদা চামড়াধারী খদ্দের। ওরাও খাচ্ছে বাংলাদেশি তরকারি দিয়ে রুটি-ভাত। আরো মজার ব্যাপার যা ইউরোপের অন্য কোন দেশে হোটেলে চোখে পড়বে কিনা অন্ততঃ আমার জানা নেই তা হলো, এখাতে হাত দিয়ে সবাই (বাঙালিরা) ভাত খেয়ে চলেছে। সংকোচহীন। খুব ভালো লাগলো। হল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে আমরা বাঙালিরা সাধারণত ঃ হাত দিয়েই বাসায় ভাত খাই। কিন্তু হোটেলে এভাবে খাওয়ার দৃশ্য কখনো চোখে পড়েনি। এ প্রসংগে রাজুর বক্তব্য বেশ মজার। সে বলে, ওরা (সাদারা) আমাদের হাত দিয়ে খাওয়া দেখে নিজেরাই লজ্জা পায়।’ মোক্কম যুক্তি বটে।
এবারের রোম সফর কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। সকাল সোয়া দশটায় রোম পৌঁছে টেক্সি নিয়ে হোটেল। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইফাদ’। ইফাদের কর্মকর্তা, পুরানো বন্ধু, জাতে ডাচ, রবেট মেইনসের সাথে লাঞ্চ পরবর্তী মিটিং। অনেক দিন পর রবেটের সাথে দেখা। সন্ধ্যেয় তার দেয়া ডিনার। তার আমেরিকান বউ লওরা আগে ভাগে এক ইতালীয় রেস্তোরাঁয় আসন রিজার্ভ করে রেখেছিল। নির্দিষ্ট সময়ে পিরামিড নামক একটি মিট পয়েন্টে গেলে দেখি দীর্ঘদেহী রবেট এগিয়ে আসে। বলে, ‘লওরার একটু দেরি হচ্ছে। চলো ইতোমধ্যে আমরা কোন একটা কপি শপে গিয়ে বসি’। লওরা চাকরি করে মার্কিন দূতাবাসে। প্রেম করেই দুজনের বিয়ে। ক্ষনিক বাদে লওরা এলে আমরা এগিয়ে যাই নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁর দিকে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা এগিয়ে চলে সময়ের সাথে সাথে। সারাদিনের কাজের ফাঁকে এই আড্ডাটা খুব দরকার ছিল। রাত তখন প্রায় এগার। পরদিন রবেট যাবে ওয়াশিংটন। লওরা যোগ দেবে পরের সপ্তাহে। ঠিক করেছেন দুজনে বছরের এই শেষ সময়টা একসাথে কাটাবে আমেরিকায়, পরিবারের বাকি সদস্যাদের সাথে। রবেটের মা-বাবাও বছর কয়েক আগে হল্যান্ড ছেড়ে স্থায়ী আবাস গেড়েছে সে দেশে।
যে কারণে এবার রোম যাওয়া। বাসুগ আয়োজিত রেমিটেন্স শীর্ষক আলোচনা। তাতে যোগ দেবার কথা বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর ডঃ মফিজুর রহমান ও ইফাদের কর্মকর্তা পেড্রো। পেড্রো জাতিতে ইতালীয়। তার সাথে বছর পাঁচেক পরিচয় ও জানা শোনা। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে জরুরি মিটিং পড়ায় শেষ মুহূর্তে তার আর থাকা হলো না বাসুগের প্রোগ্রামে। চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাসুগ ইতালী শাখা। এর পেছনে প্রচুর খেটেছে কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর রাজু, মিঠু, খান, মুনির এবং অন্যান্যরা। নিজের কাজের পাশাপাশি এরা সবাই চ্যানেল নাইনের সাথে সরাসরি জড়িত। বিশেষ করে রাজু ও মুনির। ফী মাসে প্রযোজনা করে ‘ইতালী থেকে বলছি’ নামে ৪০ মিনিটের ‘টক শো’। বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর ও বাসুগ প্রধানকে নিয়ে ‘রেমিটেন্স’ নিয়ে তারা একটি টক শো রেকর্ড করলো। তাদের উদ্যম দেখে সত্যি অবাক হবার মত।
শেষ করবো একটি চরিত্রের উল্লেখ করে। যতবারই রোম যাই উঠি ‘পাপিয়া রেস্ট হাউজ’ নামে একটি ছোট্ট হোটেলে। রোম শহরের কেন্দ্রে। এয়ারকন্ডিশান, রুমে টিভি, এটাচড বাথ, টেলিফোন সব আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এর চাইতেও ভাল হোটেল রয়েছে রোম শহরে, এই টাকায়। কিন্তু এই হোটেল যা পাওয়া যায় তা অন্য কোন হোটেলে টাকা দিয়েও পাওয়া যাবে না। সে হলো জজ মিয়া। অদ্ভুদ একটি চরিত্র। অতি সহজ-সরল একটি লোক। পুরো গ্রাম্য সরলতা তার আপাদমস্তক। ডাকার আগেই উপস্থিত। সে দিন হোক আর রাত। যেদিন রোম পৌঁছি টেক্সি থেকে নেমে ইন্টারকমে ডাকতেই তরতর করে নীচে নেমে আসে। জোর করে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যায়। তার সার্বক্ষণিক নজরদারীর কারণে একবারের জন্যেও মনে হয়নি বাইরে আছি। মনে হয়েছে দেশেই আছি। দেশের খাবার, সকালে দেশের পরোটা-ডিম ভাজি, ঘন দুধ দিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে আসা- সব কিছু করেছে বেটে খাটো জজ মিয়া। সারাটা দিন ব্যস্ত থাকে। বছর কয়েক হলো এসেছে ইতালিতে। এখন চেষ্টা করছে তার ছেলেকে নিয়ে আসতে। ছেলেকে নিয়ে আসতে পারলেই যেন তার এই কষ্ট সার্থক হবে। এমন সাদামাটা লোকের বড় অভাব-দেশে, বিদেশে। প্রার্থনা করি জজ মিয়ার ছেলেকে ইতালি আনার স্বপ্ন যেন সফল হয়।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]