[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকারের এক বছরঃ একটি প্রতিবেদন
 

 

দীপক রায়


পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃনমুল-কংগ্রেস জোট সরকারের এক বছর শেষ হয়েছে। তাই শুরু হয়েছে ফিরে দেখা, এই একবছরে কি এল হিসাবের খাতায়। সাড়ে তিন দশকের বাম জমানাকে পরাজিত করে মমতা ব্যানার্জী মসনদে বসতে গিয়ে প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলি কতটা বাস্তবায়িত হল, সেটাই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। প্রথমেই দেখা যাক খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এ বিষয়ে কি বলেছেন। তিনি তিনবারে তিনরকম বলেছেন। প্রথমে নিজের সরকারের কাজে নম্বর দিয়েছিলেন ১১০, তারপরে ১০০, আর সেদিন জানালেন ৯০ (অবশ্য ১০০ তে ১১০ দেবার বিষয়টা নিয়ে গবেষনা চলতেই পারে)। মুশকিল হল, এখানে প্রশ্নকর্তা, উত্তরদাতা, পরীক্ষক- সবই মমতা ব্যানার্জী।তাই তিনি যেমন খুশি নম্বর দিতেই পারেন। কিন্তু সংবাদপত্র, সরকারী তথ্য, নানাবিধ ঘটনা কি বলছে? কি বলছে জনমত সমীক্ষা? আসুন জেনে নিই।
মমতা ব্যানার্জীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বদলা নয়-বদল চাই। গত একবছরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলাতে বিরোধী বামেদের প্রায় ৭০ জন খুন হয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ঘরছাড়া আছে অগুন্তি পরিবার। পার্টি অফিস তৃনমুলীরা দখল করেছে প্রায় সাতশো। প্রাক্তন নেতা-মন্ত্রীদের পাঠানো হয়েছে জেলে। বিরোধীদের জড়ানো হয়েছে হাজার হাজার মামলায়। ফলে বদলের সাথে সাথে বদলা চলছে ব্যপকভাবে।
সব বেকারের কাজ চাই। সব বেকার তো দুরস্থান, সামান্য বেকারের চাকরীও এখনো অধরা। বিগত বাম সরকারের আমলে পুলিশ, বিদ্যালয়ে প্রচুর চাকরী হয়েছিল সেটা সকলেই মানেন। কিন্তু, মমতা ব্যানার্জীর আমলে এখনো চাকরী কেবল ঘোষনাতেই সীমাবদ্ধ। রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে এখনো কোন নিয়োগ হয়নি। অন্যান্য দপ্তরগুলোতেও একই চিত্র। তবু মমতা ব্যানার্জীর প্রতিদিনই নানা অনুষ্ঠানে বলে যাচ্ছেন, ৬ লাখ চাকরী নাকি হয়ে গিয়েছে! কবে, কোথায়, কিভাবে হল কে জানে?
শিল্পের বন্যা বইয়ে দেওয়া হবে। মমতা ব্যানার্জীর জমি নীতির কারনে কোন শিল্প এরাজ্যে এখনো আসেনি। ইনফোসিসের মতো তথ্য প্রযুক্তি শিল্প ঘোষনা করেছে, তারা রাজ্যে আর কাজ করবে না। হিলারী-মমতা বৈঠক কেবল হয়েছে, কিন্তু কোন কারখানার এখনো কোন খবর নেই। বরং কিছু কারখানা আর চাবাগান বন্ধ হয়েছে গত একবছরে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে দলতন্ত্রের অবসান। রাজ্যের বেশিরভাগ কলেজের ক্ষমতা জোর করে দখল করে নেওয়া হয়েছে। রায়গঞ্জ থেকে বোলপুর, কলকাতা থেকে ভাঙ্গড়- সব জায়গায় তৃনমুলের হাতে আক্রান্ত হয়েছে শিক্ষকেরা। অষ্টম শ্রেনী, মাধ্যমিক পাস বিধায়কেরা হয়েছেন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। নির্বাচিত কমিটিকে হটিয়ে তৃনমুলের নেতারা বিভিন্ন শিক্ষা সংসদের মাথায় বসে পড়েছেন। তৃনমুলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ঘোষনা করেছেন, শিক্ষকেরা সিপিএম করতে পারবেন না। এটা কোন দলতন্ত্রের অবসান?
গনতন্ত্রের প্রসার ঘটানো হবে। গনতন্ত্র দূরে থাকুক, স্বৈরতন্ত্রের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, বলেছেন মমতা ব্যানার্জীর কাছের মানুষ অধ্যাপক সুনন্দ স্যান্যাল, লেখিকা মহাশ্বেতা দেব, তৃনমুলের সাংসদঙ্গায়ক কবীর সুমন প্রমুখ। মুখ্যমন্ত্রীর সামান্য ব্যঙ্গচিত্র আকার দায়ে গ্রেফতার করে মামলা করা হয়েছে যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বরীশ মহাপাত্রকে। নোনাডাঙ্গাতে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ আন্দোলকারীদের মাওবাদী বলে হাজতে পুরে রাখা হয়েছে। মিটিং-মিছিলের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে নানা প্রক্রিয়াতে।
শান্তি ফিরিয়ে আনা হবে। রাজ্যে খুন, হামলা, ডাকাতি, ধর্ষন বহুগুন বেড়েছে। মহিলা কমিশন মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনায় রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছে। এত ধর্ষনের ঘটনা বাংলাতে অতীতে কোনদিন শোনা যায়নি। জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা আপাততঃ চুপচাপ আছে। এটা মমতা ব্যানার্জীর সাফল্য সন্দেহ নেই। কিন্তু, তিনি আন্দোলন করেছিলেন, জঙ্গলমহল থেকে যৌথবাহিনী সরানো হবে। কিন্তু, তা তিনি করেননি। ফলে আগামীতে সেখানে আবার হামলা হতে পারে মাওবাদীদের। পাহাড়ে গোর্খাদের সাথে চুক্তি কোন কাজেই লাগেনি। পাহাড়ে আগুন আরো বেশী করে লেগে গিয়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। প্রতিদিন তৃনমুলের সম্মেলনে মারামারি, ঘেরাও, ভাংচুর এখন দৈনন্দিন ঘটনা। ফলে শান্তি কোথায় বাংলাতে?
সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়া হবে। ক্ষমতায় এসেই মমতা ব্যানার্জীর আইন করেছিলেন সিঙ্গুরের কারখানার জমি চাষিদের ফেরত দেওয়া হবে। এখনো সেই জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। কাটোয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের নদীবাঁধ তৈরী, রেলের জমি অধিগ্রহন, রাস্তার জমি অধিগ্রহন- সব আটকিয়ে আছে মমতা ব্যানার্জীর জমিনীতির কারনে। ফলে তীব্র লোডশেডিং হলেও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে না, শিল্প হচ্ছে না, কাজের ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে না।
কৃষকের উন্নতি, কৃষির আরো উন্নতি। গত একবছরে রাজ্যে যা কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেটা এই বাংলায় অতীতে ঘটেনি। সরকার ধান কেনেনি, ফলে ধানের দাম বাড়েনি। একই অবস্থা পাট ও সজির। বাধ্য হয়ে ঋনের দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করেছে, প্রতিদিন এই তালিকাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম।
কোন কোন খবরের কাগজ পড়া যাবে, কোন কোন চ্যানেল দেখা যাবে, সেই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, সিপিএমের লোকেদের সাথে কথা না বলার ঘোষনা, শিশুমৃত্যু, বিভিন্ন ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রীর সাজানো ঘটনা বলা, তৃনমুলের সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর পরোক্ষ সায়, বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানে সিপিএমকে গালিগালাজ করা, নিজের দলের কথা বলা, ভুল তথ্য-ভুল বক্তব্য বলার মতো সব বিষয়ে লিখতে গেলে শেষ হবে না মমতা ব্যানার্জীর সরকারের অসফলতার কাহিনী।
কিন্তু তার সরকারের সাফল্য কিছু আছে। বিতর্কিত হলেও সেগুলি সাফল্য বলা যেতেই পারে। তৃনমুলের আন্দোলনের জন্য যেসব প্রকল্প করতে পারেনি আগের বাম সরকার, সেগুলি এখন তিনি শেষ করতে পারছেন। রেশনকার্ড, বিপিএল বিষয়ে কিছু এলাকাতে বেশ ভালো কাজ হয়েছে। কলকাতায় গঙ্গার ধার সাজানো, কিছু পর্যটন কেন্দ্র সাজানোর পরিকল্পনা, কিছু কিছু এলাকাতে ১০০ দিনের কাজ বেশ ভালো করতে পেরেছে এই সরকার। তাদেরই আন্দোলনের কারনে আটকে থাকা জাতীয় সড়কের কাজ আপাততঃ শুরু হয়েছে, যা ভালোর লক্ষন। তবে স্বাস্থ্যবীমা, কিষানমান্ডি, নিজভুমি নিজগৃহ, জলধরো জলভরো, আনন্দধারা এইসব প্রকল্পগুলি যদি সত্যিই কাজে লাগে, তাহলে সেটাও এই সরকারের ভালো কাজ বলে চিহ্নিত হবে।
স্টার আনন্দ-এসি নিয়েলসন একটি সমীক্ষা করেছে। গত এক বছরে মমতা ব্যানার্জীর সরকারের সাফল্য কোন চোখে দেখছে বঙ্গবাসী? তাদের সমীক্ষাতে দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ মানুষ, মনে করেন মাওবাদী সমস্যা, শিল্প, বেকারের কাজ, কৃষি, শিক্ষা সব বিষয়ে এই সরকার নতুন কিছু করতে পারেনি, আগের মত একই রকম আছে। আবার কিছু মানুষ মনে করছেন আগের থেকে আরো খারাপ হয়েছে।
এটা ঠিকই যে একটা বছর একটা সরকারের পক্ষে কিছুই না। কিন্তু, একটা কথা আছে, দিনের শুরু দেখলে সারাদিন কেমন যাবে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এখানেও ঠিক তাই। মমতা ব্যানার্জীর প্রতিশ্রুতি ছিল প্রচুর। তাই মানুষের আশাও প্রচুর। তিনি নিজে নিজেকে ১১০, ১০০, ৯০ নম্বর দিয়ে আত্মতৃপ্ত হতে পারেন, কিন্তু জনগন এখনো ততটা নম্বর তাকে দেবার জন্য প্রস্তুত নয়। তিনি সত্যিই কত নম্বর পাবেন, সেটা আগামীদিনে তার কাজের মাধ্যমেই বোঝা যাবে।

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
 

[প্রথমপাতা]