[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

তিলোত্তমায় রবীন্দ্র সাহিত্য

 

শাশ্বত স্বপন

‘বহু মানব তাদের বহু দিবসের শ্রম তিলে তিলে দান করে গড়ে তুলেছে এই তিলোত্তমা মূর্তি...।’ আমাকে বিস্মিত করে এমন কিছু দেখলেই রবি ঠাকুরের উক্ত লেখাটি আমার মনে পড়ে। যেমন, মহাস্থানগড়, সোমপুর বিহার অথবা হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, যমুনা ব্রীজ...। কোটি কোটি কর্মের ফলে এসব র্কীতি গড়ে উঠেছে। ঠিক তেমনি করে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ, একান্নবর্তী পরিবার , তার লেখা এবং তার লেখার উপর বহু মানুষের পরিশ্রমের ফলে রবীন্দ্রনাথকে যে সাহিত্য সভ্যতার মহাতিলোত্তমার আসনে বসানো হয়ে গেছে- তা অনুধাবন করতে পাঠক, লেখক ও তার ভক্তদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না বরং প্রতি পদে পদে, প্রতি মুহূর্তে বিস্মিত হতে হয় রবীন্দ্রনাথের একটা একটা লেখা নিয়ে ভাবলে, মনে হয় (অথবা চোখের পর্দায় ভেসে উঠে), রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্র সাহিত্য বহু তিলোত্তমা যোগে গড়া মহাতিলোত্তমার ছায়া রূপে কায়া মূর্তি।

প্রশান্ত কুমার পালের নয় খন্ডের ‘রবি জীবনী’, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবন কথা’, রবীন্দ্র নাথকে ঘিরে অজস্র চিঠি-পত্র, ভক্ত, রবীন্দ্র বিশ্লেষক, ঠাকুরবাড়ী কেন্দ্রিক লেখক ও স্মৃতিচারণকারীদের হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে অর্ধেক জীবন পার হয়ে যাবে; বাকী অর্ধেক জীবন পার হবে রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক পড়ে, রবীন্দ্র সংগীত পড়ে, শুনে। তার ও তাকে ঘিরে- এই এক জীবন পাড় করে দেওয়ার মত লেখা কর্মযজ্ঞকে তিলে তিলে গড়া তিলোত্তমা রুপে বিস্মযকর রবি সাহিত্য সভ্যতা বলা যেতে পারে।

আর এই সাহিত্য সভ্যতার ভ্রণ নিয়ে সামান্য আলোকপাতঃ জোড়াসাঁকো। কলকাতার মেছুয়া বাজার এলাকায় অখ্যাত পাড়া, পাড়া থেকে গ্রাম। ইতিহাসে যে কোন সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে এবং ইতিহাসে ব্যক্তি অথবা পরিবার সম্ভ্রান্ত, ঐশ্বর্যশালী হয়েছে হাট-বাজার-নগরকে কেন্দ্র করে-  তা বালিহাটির জমিদার হোক আর ভাগ্যকূলের জমিদার হোক- সবাইকে পরিশ্রম করে, ব্যবসা করে অঢেল অর্থ রোজগার করে জমিদারী কিনতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ সালে জোড়া সাঁকোতে বসবাস করতে শুরু করেন। কোথা থেকে তার এখানে এলেন- তা জানা যায় না। তবে কথিত আছে যে, শুরুতে তাদের ঠাকুর উপাধী ছিল না- ছিল ‘কুশারী’ উপাধী। তবে রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথকে এই উপাধী ধারণ করতে হয়নি- জন্ম থেকেই তারা ঠাকুর উপাধী ধারণ করেছেন। সে যাই হোক, নীলমণির দুই ছেলে সম্পর্কে জানা যায়- রামলোচন ও রামমনিঃ রামমণির ছোট ছেলে দ্বারকানাথ জন্মের এক বছরের মধ্যে মাকে হারান। রামলোচন একমাত্র কন্যা শিবসুন্দরীর অকাল মৃত্যুর পর দ্বারকানাথকে দত্তকপুত্র হিসাবে গ্রহন করেন। রামলোচনের অঢেল সম্পতি ছিল এবং তিনি তা অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৩ বছর বয়সী দত্তক পুত্র দ্বারকানাথকে যে সম্পতি উইল করে দিয়ে যান তা হল (উইলের ভাষায়)ঃ ‘যশোহর জেলার জমিদারী পরগণা বহরামপুর শহর কলিকাতার মধ্যে ডোম পিদরু সাহেবের দখলাধীন জায়গা রামদেব বাইতির দখলাধীন জায়গা কৃঞ্চ›চদ্র রায় কবিরাজের দখলাধীন জায়গা তিলক বসাকের দখলাধীন জায়গা শঙ‹র মুখোপাধ্যায়ের দখলাধীন বাটী রতন বাড়ের দখলাধীন বাটী - ‘এই বাটী তোমার মাতাকে দিয়াছি’ নিজ বাটী ধর্ম্মশার বাটী বড়বাজারের বটতলার বাটী জানবাজারের হাড়িগোলার জায়গা ডোমটোলার জায়গা মান্নতের দখলাধীন জায়গা কলিঙ্গা ব্রহ্মচারীর দখলাধীন জায়গা ব্রহ্মতের জমি মৌজে কপিলেশ্বর দখলাধীন জায়গা ব্রহ্মত্তর জমি...।’এতসব সম্পত্তির কারনেই তারা বিখ্যাত ঠাকুর জমিদার পরিবার । অনেক বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ বলেন, রাজা রামমোহন রায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কারনেই আধুনিক বাংলার গোড়াপত্তন। তবে আশ্চর্য এই যে, দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথ পিতামহের বিষযে কোথাও তেমন কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। এই অঢেল সম্পত্তির জমিদার পরিবার থেকে জন্ম নেওয়া, পরবর্তীতে নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হওয়া যার লেখা গান দু'টি দেশে (বাংলাদেশ, ভারত) জাতীয় সংগীত হিসাবে মর্যাদা পাচ্ছে। শ্রীলংকার জাতীয় সংগীতের রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন রবীন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন এবং তামিল ভাষায় লেখা জাতীয় সংগীতে রবিঠাকুরের সুরের মিল রয়েছে।

বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ, কৃষ্ণাত্রয়োদশীর শেষ রাতে ৬নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির মহর্ষি ভবনে ১৪শ সন্তান বা ৮ম পুত্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। ৫ বছর বয়সে ভ্রাতা সোমেন্দ্রনাথের সাথে হাতে খড়ি। ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা আরম্ভ। ১২ বছর বয়সে প্রথম অপৌত্তলিকভাবে রবীন্দ্রনাথসহ তিন জনের উপনয়ন এবং গায়ত্রীমন্ত্র সম্পর্কে তার অর্থবোধের চেষ্টা। বাড়ীতে স্কুলের মত পরিবেশে সংস্কৃত ‘কুমার সম্ভব’ ও ইংরেজী ‘ম্যাকবেথ’ নাটক পাঠ এবং তা বাংলায় রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করতে হয়। ১২ বছর বয়সে বালক রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘অভিলাষ’ কবিতা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৪ বছর বয়সে হিন্দু মেলার বার্ষিক উৎসবে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। এই কবিতা ‘হিন্দুমেলার উপহার ’নামে দ্বিভাষী ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ‘ জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ মাসিকে ১২৮২ অগ্রহায়ণ হতে ১২৮৩ কার্তিক পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বনফুল কাব্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এভাবেই গড়ে উঠেছে সাহিত্য সভ্যতার ভ্রণ থেকে আজকের তিলোত্তমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]