[প্রথমপাতা]

 

 

 

বাংলাদেশ বিমানের ফকার-২৭ দুর্ঘটনাঃ তিন দশক ধরে রহস্য অনুদ্ঘাটিত

 

 

কমিউনিটি রিপোর্ট ।।

৫ অগাষ্ট ১৯৮৪, রোববার। প্রবল বর্ষণে রাজধানী ঢাকা সিক্ত হচ্ছিলো। বিকেলে সারা দেশের মানুষ শুনলেন এমন এক দুর্ঘটনার কথা যা আগে বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে উড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার-২৭ বিমান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানন্দর) অবতরণকালে বিধ্বস্ত হয়। বিমানের ৪৫ জন যাত্রী এবং ৪ ক্রুর সকলেই দুর্ঘটনায় নিহত হন।

তৎকালীন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী আব্দুর রহিম ইউসুফ ১৫ দিনের মধ্যে তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা দেন। তবে প্রায় ৩ দশক পরেও সেই তদন্তের ফল কী হয়েছিলো তা জানা যায়নি। সামরিক সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রনের ফলে প্রকাশ পায়নি ককপিট ভয়েস রেকর্ডার ও ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারের তথ্যও। অথচ সে সময় বিটিভিতে ব্ল্যাকবক্স দু'টি উদ্ধারের চিত্র অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন। তাই আসলে সেদিন কী ঘটেছিলো তা হয়তো দেশের মানুষ কোনো দিনই জানতে পারবেনা।

কমিউনিটি নিউজ দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব উদ্যোগে দুর্ঘটনাটি সম্পর্কে নানা ভাবে তদন্ত করার চেষ্টা করে। এতে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য।

সেদিন বিকেল ৫টার কিছু আগে বিমানটি শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। এ সময়ে বিমানটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রুখসানা। বেতার যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কায়সার।

কন্ট্রোল টাওয়ার ক্যাপ্টেন রুখসানাকে রানওয়ে ২৩ এ অবতরণের জন্যে ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে।

প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দৃষ্টিসীমা সীমিত হয়ে আসায় বিমানটিকে রানওয়ে স্বচক্ষে দেখে অবতরণ করানো অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। তারা ভিওআর বা বেতারের সাহায্যে বিমানটিকে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাদের প্রথম দফা অবতরণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারা উড়ে গিয়ে আরেক দফা অবতরণের চেষ্টা চালান।

দ্বিতীয় দফায় তারা আইএলএস বা ইনস্ট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করে অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নিলে কন্ট্রোল টাওয়ার তাদেরকে রানওয়ে ১৪ তে অবতরণ করার কথা বলেন। আইএলএস ব্যবহার করলে বিমানের যন্ত্রপাতিই পাইলটকে সঠিক পথে রানওয়ে'র পাদদেশে নিয়ে যায়। কাজেই এ ক্ষেত্রে পাইলট উইন্ডস্ক্রিনে নজর না রেখে তার ককপিটের সরঞ্জামে নজর রাখলেই চলে। ভারী বর্ষণের মধ্যে প্রবল ঝোড়ো বাতাসে ক্যাপ্টেন রুখসানা অবতরণের চেষ্টা চালালে ক্রস উইন্ড বা পার্শ্বমুখি বাতাসের ঝাপটায় অবতরণ করাতে এ দফাতেও ব্যর্থ হন। রুখসানা ঘুরে এসে আরো এক দফা চেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।

তৃতীয়বারও আইএলএস ল্যান্ডিংয়ের জন্যে বিমানটি তার প্রয়োজনীয় পথ ঘুরে আসে। এরপর অবতরণের উদ্যোগ নেয়ার সময় বিমানের সাথে কন্ট্রোল টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই অবতরণ করতে গেলে বিমানটি রানওয়ের ৫৫০ মিটার আগে একটি ৩০ ফুট গভীর পুকুরে পতিত হয়।

কিন্তু কেন বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হলো? বিমানের যন্ত্রপাতিতে কোনো সমস্যা ছিলো নাকি পাইলটের ভুল? ব্ল্যাকবক্সের তথ্য ও বিধ্বস্ত বিমান পরিদর্শন ছাড়া সন্দেহাতীত ভাবে এ কথা বলা অনেক শক্ত। তবে দুর্ঘটনার কারণ হয়তো কিছুটা অনুমান করা যায়।

সেদিন দ্বিতীয় দফাতেও ব্যর্থ হওয়ার পর কেন ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রুখসানা অবতরণের সিদ্ধান্তে অটুট থাকলেন তা একটি বড় প্রশ্ন। প্রতিকূল আবহাওয়ায় পাইলট বিমানবন্দরের পরিস্থিতি অবতরণের উপযুক্ত মনে না করলে তিনি অবতরণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারেন। তিনি ফিরে যাওয়ার বা নিকটবর্তী অন্য কোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারতেন -প্রথম দফা ব্যর্থ হওয়ার পরেই।

দুর্ঘটনার পরে বাউনিয়া গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা ঝড়ের সময় প্রবল বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেছেন এবং বিমানের ডানা থেকে ধোঁয়া উড়ছিলো। একজন জানিয়েছিলেন, তিনি বিমানের উপর বজ্রপাত আঘাত হানার দৃশ্য দেখেন।

আধুনিক বিমানের উপর বজ্রপাতের তেমন বিশেষ কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু দুর্ঘটনা গ্রস্ত ফকার বিমানটি ১৯৭১ সালে প্রথম উড্ডয়ন করে। এর উড্ডয়ন ঘন্টা ১৫,৫৯৫। এতো পুরোনো বিমানের উপর বজ্রপাতের প্রভাব একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না।

আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে উইন্ড শিয়ার। প্রবল ঝোড়ো আবহাওয়ায় বিপুল শক্তির বাতাস মাটিতে আছড়ে পড়ে। এরমধ্যে ঢুকে গেলে বিমানের রেহাই পাওয়া এক রকম অসম্ভব। ঘটনার দিন দমকা বাতাস ছিলো। কাজেই উইন্ড শিয়ার এর বিষয়টিও দুর্ঘটনার একটি কারণ হতে পারে।

তৎকালীন বিমানমন্ত্রী আব্দুর রহিম ইউসুফ বলেছিলেন, দুর্ঘটনার ১০ মিনিট আগে বিমানটির সাথে কন্ট্রোল টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বজ্রপাতের ফলে বিমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা যেমনটা বলেছিলেন, ডানা থেকে ধোঁয়া ওড়ার কথা -এর কোনো কারণ স্পষ্ট নয়। ডানা ক্ষতিগ্রস্ত হলে জ্বালানি কিম্বা হাইড্রোলিক লিক হয়ে এমনটা হতে পারে। কিন্তু বিমানের পাইলটরা কোনো ধরণের যান্ত্রিক ত্রুটির কথা কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানাননি। কাজেই বিমানটিতে বজ্রপাত আঘাত হেনেছিলো বা কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিলো তা সঠিক ভাবে বলা যায়না।

বিমানের চারটি কোনা অর্থাৎ, লেজ, দুই ডানা এবং ককপিটের সম্মুখ ভাগ সবই ছিলো পুকুরে। যার অর্থ দাঁড়ায়- বিমানটি পুকুরে আঘাত হানার আগ পর্যন্ত অক্ষত ছিলো। মাঝ আকাশে বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার খন্ডিত অংশ গুলো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তো।

কিন্তু কেন বিমানটি রানওয়ের ৫৫০ মিটার আগে পুকুরে পতিত হয়েছিলো? পাইলট কি বিমানের নিয়ন্ত্রন হারিয়েছিলেন? রানওয়েকে এতো দূরে রেখে পাইলট ভুল করে রানওয়ে ভেবে বিমানকে পুকুরে অবতরণ করাবেন এটি কল্পনা করা কষ্টকর।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন বিমানের ডানা থেকে তারা ধোঁয়া উড়তে দেখেছিলেন। বিমানের জ্বালানি বা হাইড্রোলিকস লিক হলে ভূমি থেকে সেটি ধোঁয়ার মতই দেখায়। বিমানের ডানার বিভিন্ন অংশ যেমন -ফ্ল্যাপ, স্ল্যাট, এলুরন, এলিভেটর, লেজের রাডার ইত্যাদি সব নিয়ন্ত্রিত হয় এক ধরনের তরল বা হাইড্রোলিক দিয়ে। ফকার-২৭ বিমানের ইঞ্জিনের সম্মুখে প্রপেলার অবস্থিত। বজ্রপাত বা অন্য কোনো কারণে এই প্রপেলার ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যদি ডানার এমন অংশে আঘাত হেনে থাকে যেখান দিয়ে হাইড্রোলিক ফ্লুইড এর লাইন প্রবাহিত হয়েছে -তাহলে দুর্ঘটনার একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

বিমানের হাইড্রোলিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখান দিয়ে বিমানের হাইড্রোলিক ফ্লুইড বেরিয়ে পড়া সম্ভব। এ রকম অবস্থায় বিমানকে নিয়ন্ত্রন করা পাইলটের পক্ষে খুবই কঠিন, কারণ বিমানের উচ্চতা, গতি নিয়ন্ত্রন, দিক, ভারসাম্য রক্ষায় পাইলট অক্ষম হয়ে পড়েন। আর যখন বিমানটি অবতরণ করতে যাচ্ছে -অর্থাৎ উচ্চতা কম, সেক্ষেত্রে হাইড্রোলিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমানকে নিয়ন্ত্রন করা প্রায় অসম্ভব।

কাজেই বিমানের হাইড্রোলিক ত্রুটি দুর্ঘটনার একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে।


তবে সেদিনের দুর্ঘটনা হয়তো বা এড়ানো যেতো যদি ক্যাপ্টেন রুখসানা প্রথমবার বা দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হওয়ার পর নিয়মানুযায়ী আর তৃতীয় চেষ্টা না করে অন্য কোথাও অবতরণ করানোর প্রচেষ্টা চালাতেন। এখানে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেনো পাইলটের অন্ততঃ একটি ভুলকে চিহ্নিত করা যায়।

বাংলাদেশের কোনো সরকার যদি সত্যিই বাস্তবে কি ঘটেছিলো তার তদন্ত ফল প্রকাশ করেন তবে এদেশের জনগন সেদিনকার ঘটনা সঠিক ভাবে জানতে পারবেন।

তথ্যসূত্রঃ

১। অ‌্যাভিয়েশন সেইফটি নেটওয়ার্ক
২। দ্যা কুরিয়ার
৩। ব্যুরো অফ এয়ারক্রাফট অ‌্যাকসিডেন্ট আর্কাইভ
৪। নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া

 

 

>>কমিউনিটি বিশ্বকোষঃ আর্কাইভ

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]