[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

কেমো নিয়ে কথা

  

 

আরিফা নাজনীন

[অক্টোবর মাস বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার সচেতনার মাস হিসাবে পালিত হয়। ব্রেষ্ট ক্যানসার রোগী ও সহানুভুতিশীল মানুষের সহযোগিতায় পরিচালিত ”ফ্রেন্ডস হ্যান্ড ব্রেষ্ট ক্যানসার সাপোর্ট সোসাইটি” প্রতি বছর এই উপলক্ষ্যে ঢাকায় বার্ষিক সম্মেলন করে। সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ব্রেষ্ট ক্যানসার সার্জন ডাঃ সৈয়দা হাসিনা আজমের অনুরোধে এই লেখাটি বার্ষিক প্রকাশনায় সংযুক্ত করা হয়েছে। এই বছর তিনি গত কয়েক মাস আগে দুদিনের জন্য জাপান সফর করেন।]


সম্পতি শোনা যাচ্ছে, সিলিকন স্কাল্প কুলিং হেলমেট দিয়ে কেমোথেরাপি পাওয়া রোগীর চুল পরা বন্ধ করা গেছে। অনেকেই হয়তো জানতে চাইবেন, আসলে ব্যাপারটা কেমন?
রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে অথবা সরাসরি ব্রেষ্ট ক্যানসার (কিংবা অন্য কোন ক্যানসার) কোষ অপ্রতিরোধ্যভাবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরলে, যদি অপারেশন করে ক্যানসারগুলি পুরোপুরি কেটে বাদ দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে কেমোথেরাপি দিয়ে কেবল মাত্র ক্যানসার কোষগুলি ধ্বংস করে দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এই চিকিৎসায় সাময়িকভাবে চিকিৎসা চলাকালীন সময় শরীর খারাপ লাগে, অনেকের চুল পরে যায়। কেমোর ঔষধ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সব জায়গায় পৌছে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাওয়া ক্যানসার কোষগুলি খুজে বের করে তাদের বিভাজন ও পুষ্টি যোগান দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ক্যানসার কোষগুলি অপুষ্ট থেকে ধীরে ধীরে মরে যায়। মানুষের চুলও খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়, প্রতিদিনে ০.৩৫ মিমি। কেমো চিকিৎসা চুলের সাময়িক বৃদ্ধি বন্ধ করে দিতে পারে। কেমো শুরু করার ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে চুল পরা শুরু হয়। তবে আশার কথা চিকিৎসা বন্ধ করলে ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে আবার চুল গজায়, প্রথম প্রথম হয়তোবা অন্য রংয়ের, অন্য আকৃতির।
কেমো চিকিৎসায় চুল পরা বন্ধ করার দুইটি উপায়।
১. চুলের গোড়ায় রক্তের প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে কম পরিমানে কেমো পৌছানো
ধ. কেমো চলাকালীন সময়টুকু কৃত্রিমভাবে বাতাসের চাপ তৈরি করে রক্তনালী বন্ধ করে দেওয়া যায়। এই চাপ সিষ্টোলিক ব্লাড প্রেশারের চেয়ে বেশি হতে হবে (>১০০-১৮০ মিমি মার্কারি)। এতে চুল পরা কমানো গেলেও রক্ত সঞ্চালন কম হওয়ার পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দেয় মাথা ব্যথা আর নার্ভে বেশ চাপ পরে
ন. কেমো চলাকালীন সময়ে চুল ভর্তি এলাকায় মাথার তাপমাত্রা কোনভাবে কমিয়ে ফেলা। তাপমাত্রা কমিয়ে ফেললে কোষগুলি নিস্তেজ হয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পুষ্টি এবং কেমো গ্রহন করে। ঠান্ডায় রক্তনালী সংকোচিত হয়ে যায়। তাই চুলের ক্ষতি কম হয়। চুল পরা বন্ধ করতে হলে এই পদ্ধতি ৫০-৮০% সফল। চুল আছে মাথার এমন অংশের তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেন্টগ্রেডের নীচে নামিয়ে দিতে হবে, শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেন্টগ্রেড।

২. নির্দিষ্ট এলাকায় ঔষধ লাগিয়ে চুলের উপর কেমোর প্রভাব নষ্ট করে দেওয়া। বর্তমানে গবেষনাধীন বেশ কিছু ঔষধ ভাল চলবে বলে মনে হলেও এই পদ্ধতি এখনও মানুষের ব্যবহারোপযোগী নয়, অন্য জীবজন্তুর উপর পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

মাথার তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়ার জন্য শীতল কিছু মাথায় জড়িয়ে নিলে ভাল হয়, যেমন ঠান্ডা জেল ভর্তি প্যাকেট অথবা তোয়ালে। হয়তোবা এটা ভারি বোঝা মনে হতে পারে। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হালকা সিলিকনের হেলমেট তৈরি করেছে যাতে অনবরত শীতল তরল প্রবাহ করে তাপমাতা দুর থেকে নিয়ন্ত্রন করা যায়। এভাবে চুল পরা কমানোর উপায়টি যাদের লিভার ফাংশন ভাল নয় তাদের জন্য তেমন কার্যকর নয়। কারন লিভার ঠিকমত কাজ করতে না পারায় কেমো বেশিক্ষন রক্তে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কতক্ষন সময় নিয়ে কেমো শরীর থেকে বের হয়ে যাবে নির্ধারন করা কঠিন ব্যাপার। চুল না পরার জন্য কেমো শরীরে থাকা অবস্থায় মাথা ঠান্ডা না রাখলেই নয়। ব্রেষ্ট ক্যানসারের রোগীদের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি খুবই সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা প্রয়োজন, যদিও এডজুভেন্ট ট্রিটমেন্ট পাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই সাফল্যময় ব্যবস্থা। এছাড়া যেসব ক্যানসারের চামড়ায় ছড়িয়ে পরার প্রবণতা রয়েছে সেসব ক্যানসারে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। পর্যবেক্ষনে একজন রোগী পাওয়া গেছে যার চুল না পরলেও পরবর্তিতে কম কেমো পাওয়া মাথার চামড়ায় ক্যানসার মেটা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া যেসব ক্যানসার রক্তবাহিত (যেমন লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা) সেসব ক্যানসারে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।
সব কেমোতেই চুল পরে যায় এমন নয়। কি কেমো, কি পরিমান (ডোজ), কি ভাবে দেওয়া হলো (ইন্ট্রাভেনাস, বড়ি মুখে খাওয়া) এগুলোর উপর নির্ভর করে। কেবল মাথার চুল পরে যায় তা নয়, চোখের ভুরু, পাপড়ি, দাড়ি, বগলের চুল ইত্যাদি পরে যেতে পারে। কেমো ছাড়া রেডিয়েশন দিয়ে চিকিৎসা করলেও আঞ্চলিক এলাকায় চুল পরে যেতে পারে যা কি না উপরের পদ্ধতি দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। আপনার অভিজ্ঞ ডাক্তারের আন্তরিক সহায়তা নিন।
চুল পরে গেলেও মাথার যত্ন নিতে হবে। বাইরে বের হলে মাথা আরামদায়ক আবরন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ঘুমানোর সময় আরামদায়ক বালিশ ব্যবহার করতে হবে। মাথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধোয়া সপ্তাহে দু’দিনের বেশি নয়। পরিমিত রক্ত চলাচলের জন্য হালকা ভাবে মাথা ম্যাসেজ করতে হবে। অনেকে মাথায় টুপি পরেন, কেউ উইগ। ইসলাম ধর্মে উইগ পরা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, অন্যের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা অনুচিত। বোখারী শরীফের ষষ্ঠ খন্ডে ২২৭১ নম্বর হাদিসে এর বর্ননা রয়েছে।
সকলের নিরাপদ সুস্বাস্থ্য কামনা রইল।

আরিফা নাজনীন
এম বি বি এস, পি এইচ ডি (প্যাথলজি)
সহকারি অধ্যাপক
নাগাসাকি ইউনিভার্সিটি
জাপান
 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]