প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

পেছনে ফেলে আসি—০৮: আমার চেনাজানা ফারুকবৃন্দ

 

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

আমার চেনাজানা সার্কেলে ফারুকের সংখ্যা কতো? অসংখ্য না হলেও সংখ্যায় তাঁরা অনেক। কয়েকজনের কথা বলি। আমাদের ছড়ার ভুবনে আছে তিন তিনটে ফারুক—ফারুক নওয়াজ, সৈয়দ আল ফারুক এবং ফারুক হোসেন। কবিতার অঙ্গণে আছেন ফারুক মাহমুদ। বিটিভির বার্তা বিভাগে ছিলেন ফারুক আলমগীর। সাপ্তাহিক চিত্রালীতে ছিলেন সাংবাদিক ফারুখ ফয়সল। বিটিভির শিল্পনির্দেশক ছিলেন মহিউদ্দিন ফারুক। ব্যাংকিং সেক্টরে আছেন ফারুক মঈনউদ্দিন। জার্মান বেতার ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আবদুল্লাহ আল ফারুক। এঁদের সবার সঙ্গেই আমার ব্যাক্তিগত সম্পর্কটি চমৎকার। দেখা যাচ্ছে আমার জীবন ফারুকময়!

একসময় গায়ক ফারুক আমার খুব পছন্দের ছিলেন। খন্দকার ফারুক আহমেদ। ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমার জনপ্রিয় সেই গানটার শিল্পী—‘নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তায় চলেছি একা/এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা’। একসময় লোকের মুখে মুখে ফিরতো এই গান। তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গান বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো একসময়। আমি সিনেমা আর গানের পোকা ছিলাম সেই ছেলেবেলা থেকেই। স্বাধীনতার পর খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমায় প্রথম আমার দৃষ্টি কাড়েন চিত্রনায়ক ফারুক। এই ছবিতে ফারুকের চরিত্রটি ছিলো শহুরে যুবার। পরবর্তীতে সুজন সখী, নয়ন মনি আর লাঠিয়াল নামের ছবিতে গ্রামের যুবক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ফারুকের আলাদা একটা ইমেজই দাঁড়িয়ে গেলো। গ্রামীন যুবক মানেই ফারুক। এবং গ্রামীন যুবক ফারুক মানেই চমৎকার মানিয়ে যাওয়া। সারেং বউ ছবিতে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি আবদুল জব্বারের কণ্ঠে লিপসিং করেছিলেন নায়ক ফারুক। ইউটিউবে এই গানটি আমি নিয়মিত শুনি এবং দেখি। সারেং ফারুককে আমার বন্ধু বলেই ভ্রম হয়।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ছিলো একজন ফারুক। আহমেদ ফারুক হাসান। সাংবাদিক হিশেবে পরবর্তী জীবনে খুবই সাফল্য অর্জন করেছিলো বন্ধুটি। নিউজ এডিটর হিশেবে ওর দক্ষতা ছিলো ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনাকারী ‘আজকের কাগজ’-এর প্রথম বার্তা সম্পাদক ছিলো আহমেদ ফারুক হাসান। মানবজমিনসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেছে। ওর সর্বশেষ কর্মস্থলটি ছিলো দৈনিক যুগান্তর। যুগান্তরের বদমেজাজী কিন্তু মেধাবী বার্তাসম্পাদক হিশেবে ওর সুনাম ছিলো সাংবাদিক ও সংবাদপত্রমহলে। ওর অধীনে কাজ করা খুব কঠিন ছিলো। কিন্তু ওর মেজাজ আর নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়ে কাজ করা তরুণরা স্বীকার করেছে যে—অনেক শিখেছে তারা যোগ্য ও পড়ুয়া এই বস অথবা সহযোদ্ধার কাছ থেকে।

আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ছিলো তুই-তুই পর্যায়ের। আমরা পরষ্পরকে গালাগাল ছাড়া কোনো বাক্যই শুরু করতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমাদের তুমুল যৌবনের দিনগুলোয় টিএসসিতে এক বিকেলে ফারুক আমাকে বাড়তি খাতির করা শুরু করলো। আমার প্রতি ওর সন্দেহজনক সমীহকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিতেই আমার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিতে দিতে ফারুক বলেছিলো
—হারামজাদা বিসিএস গাইড বুক-এ একটা প্রশ্নের উত্তর হইলি তুই। তোরে রেস্পেক্ট না দেখাইলে তো কবীরাগুনাহ্ হবে রে...!

--গোপনে গোপনে বিসিএস দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিস নাকি রে হারামজাদা?

জবাবে ফারুক রহস্যজনক বাঁকা হাসিতে সামান্য হেলে গিয়ে এমন ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকতে শুরু করলো যে--উত্তরটা হ্যাঁ-ও হতে পারে আবার না-ও হতে পারে।

বিচিত্র বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা ছিলো ফারুকের। কবিতা লিখতো। অনুবাদ এবং মৌলিক কয়েকটি বইও বেরিয়েছিলো ওর। ২০০৮-এর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আমার সেলফোনে ফারুকের কল
—অই হারামজাদা তুই দেখি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাইছোস! পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনজনের মইধ্যে দুইজনের ছবি পাইছি, তোরটা কই পাই? তোর রঙিন একটা ছবি লাগবো, এখনই। পেজ মেকাপ করতাছি।

ফারুক তখন যুগান্তরের বার্তা সম্পাদক। আমি বললাম—তুই ব্যাটা ঘোড়ার ডিমের নিউজ এডিটর হইছোস। আমার মতো মহান লেখকের ছবি যে তোর কাছে নাই এইটাই তো তোর অযোগ্যতার বড় প্রমাণ রে হারামজাদা...পদত্যাগ কর ব্যাটা...

--টাইম নাই দোস্তো। একটা ছবি ইমেইলে পাঠা জলদি।

--পারলে নিজেই যোগাড় কইরা ছাপ। আমি তোরে কোনো ছবি পাঠামু না।

পরদিন সকালে দেখলাম যুগান্তরের শেষ পাতায় খুব সুন্দর ট্রিটমেন্ট দিয়ে যতীন সরকার, মঞ্জুরে মাওলা এবং আমার রঙিন ছবিসহ নিউজটা ছেপেছে ফারুক। পুরনো একটা রঙিন গ্রুপ ছবি থেকে আমাকে কেটে বের করেছে বেচারা। আমার প্রতি ওর বিপুল ভালোবাসা ছিলো। আহমেদ ফারুক হাসান নামের আমার এই বন্ধুটি ২০০৯ এর ০৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যুগান্তরের বার্তাকক্ষে দায়িত্বপালন করার সময়ই আক্রান্ত হয়েছিলো ম্যাসিভ হার্ট য়্যাটাকে। রাতে টেলিভিশনে ওকে নিয়ে স্ক্রল আর রিপোর্ট দেখে অশ্রুসজল আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলাম নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলমকে। আমার ফোন পেয়ে অপর প্রান্তে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন সাইফুল ভাই—ফারুক আর নাই রে!

মতিঝিলের যুগান্তর কার্যালয়ের প্রশস্ত লবিতে শামিয়ানা টানিয়ে ফারুকের শোকসভার আয়োজন করেছিলো ওর সহকর্মীরা। আমিও গিয়েছিলাম বিষণ্ণ সেই বিকেলে। প্রিয় বন্ধুর স্মৃতিচারণ করে আমাকেও কিছু বলতে অনুরোধ করেছিলো শোকসভার সঞ্চালক। মনে আছে, সেই বিকেলে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কাঁদতে কাঁদতে খুবই হৃদয়স্পর্শী বক্তৃতা করেছিলো প্রীতিভাজন সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান।


কানাডায় আমার প্রবাস জীবনটাকে আমি যাপন কিংবা উদযাপন করি একান্ত নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে। এখানে, শামুকের মতো গুটিয়ে থাকা জীবন আমার। সীমাবদ্ধ জলে এবং সীমিত সবুজে নিজের একটা পৃথিবী আছে আমার। আমার এই পৃথিবীর বাসিন্দার সংখ্যাও হাতেগোণা। আগেই বলেছি আমার জীবনটা ফারুকময়। কানাডায় এসেও নতুন একজন বন্ধু পেয়েছি আমি—যাঁর নাম ফারুক! ফারুক হোসেন। অটোয়ার লিঙ্কনফিল্ড মল-এ ‘কাস্টোমাইজ ইট’ নামে ঝলমলে একটা দোকান আছে তাঁর। বর্ণিল টিশার্টে বর্ণাঢ্য ছবি আর কথামালা মুদ্রণের চমৎকার প্রিন্টিং সেন্টার ওটা। ওখানে প্রায় প্রতিদিন জম্পেশ আড্ডা জমে আমাদের। ঢাকার ফারুকদের মতো কানাডার ফারুকের সঙ্গেও নির্মিত হয়েছে আমার ছোট্ট ছোট্ট নানান রঙের অপরূপ কিছু স্মৃতির মোজাইক। নম্র আর বিনয়ী স্বভাবের পরোপকারী এই মানুষটাকে অটোয়ার বাঙালি কম্যুনিটির সিংহভাগ সদস্যই পছন্দ করেন হৃদয় থেকে। বাঙালি তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি প্রিয় ফারুক মামা। তরুণদের যে কোনো উদ্যোগ-আয়োজনে সবার আগে সহযোগিতার হাতটি বাড়িয়ে দেন তিনি আন্তরিক সহমর্মিতায়। কাউকে এয়ারপোর্টে রাইড দিতে হবে? কিংবা কাউকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক করতে হবে? রাত দেড়টা হোক বা ভোর পাঁচটা হোক—ফারুক হোসেন হাজির।

ঢাকার শাহবাগ চত্বরের সমর্থনে অটোয়ার বাঙালি শিক্ষার্থী তরুণ প্রজন্মের ব্যানারের পাশে অবলীলায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসেন। একাত্তরে কিশোর ফারুক দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার বিষয়ে আপসহীন এই বন্ধুটির সঙ্গে দেখা করতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন-আনোয়ার-শিকদার এবং অন্যরা। লিঙ্কনফিল্ড মল-এর ফুড কোর্টে বসে দেশের সেরা সন্তান এই মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিতর্পণ করেন একাত্তরের উত্তাল সেই দিনগুলোর। আশ্চর্য সেই সময়ে তাঁরা দেশের জন্যে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন সীমাহীন সাহসীকতায়।

প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান সস্ত্রীক অটোয়া বেড়াতে এসে ফারুক হোসেনের সঙ্গে একান্ত ঘরোয়া আড্ডায় শামিল হয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত এই মানুষটিকে খুবই পছন্দ করেছিলেন আবেদ খান-সানজিদা আখতার দম্পতি। বাংলাদেশ থেকে ফোন করে ওরা আমার পরিবারের সদস্যদের বাইরে একমাত্র ফারুক হোসেনের কথাই জিজ্ঞেস করেন।

গেলো বছর এক সকালে ‘কাস্টমাইজ ইট’ নামের দোকানটিতে ফারুক হোসেন জানালেন—গত রাত থেকে তাঁর বুকে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাটা এখনও বহাল আছে। ‘উই উইল বি ব্যাক ইন টেন মিনিটস্’ নোটিশ ঝুলিয়ে অনেকটা জোর করেই তাঁকে নিয়ে বসালাম আমার গাড়িতে। তিনি তাঁর গাড়ির চাবি আমার কাছে রেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কিছুই হয়নি টাইপ হাসি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মল থেকে বেরিয়ে আমার পাশের সিটে বসলেন। দ্রুত তাঁকে নিয়ে গেলাম অটোয়া সিভিক হসপিটালে। ইমার্জেন্সির গেইটে তাঁকে রেখে আমি চলে এলাম। তিনি বললেন—আমি কল দিলে আমাকে এসে নিয়ে যাবেন।
কিছুক্ষণ পরেই তাঁর কল পেলাম। ইসিজি ইত্যাদি টেস্ট বলছে কাল রাতেই তাঁর হার্টে একটা ম্যাসিভ য়্যাটাক হয়েছে। রাতেই হাসপাতালে আসা উচিৎ ছিলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে ।এক্ষুণি তাঁকে ওরা ওটি-তে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন হবে।
অপারেশন হলো। হৃদয়ে মূল্যবান আঙটি ধারণ করে নাগাড়ে প্রায় একমাস তাঁকে থাকতে হলো হাসপাতালে এবং পূর্ণ বিশ্রামে। হৃদয়বান মানুষই তো আক্রান্ত হন হৃদরোগে! সহৃদয় এই মানুষটির জন্মদিন আজ, ১৩ মে। অতি আধুনিক দেশ হলেও কানাডার বহু মানুষ সুপারস্টিশন বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে বিশেষ করে একটি সংখ্যার ক্ষেত্রে। সংখ্যাটি হলো ১৩। আনলাকি থার্টিন। কানাডার কোনো ভবনে ১৩ তলা আছে? বিশাল বিশাল ভবনগুলোর লিফট্ বা এলিভেটরে উঠে আপনি ১৩ নাম্বারের কোনো পুশবাটন পাবেন না। ১০,১১, ১২ এর পর ১৪, ১৫, ১৬ এভাবে সিরিয়াল করা সব কটা ভবনের সব কটা তলা। সরকারি বেসরকারি কোনো ভবনেই ১৩ তলা বলে কোনো বস্তু আমি অন্তত দেখিনি। থার্টিনকে আনলাকি ভাবার যৌক্তিক কারণ না থাকলেও কানাডার কোনো এপার্টমেন্টে ল্যাণ্ডলর্ড বা বাড়িওলা ১৩ তলা হিশেবে কোনো তলাকে চিহ্নিত করেন না। কারণ তাহলে ওই তলায় ভাড়াটে পাওয়া দুষ্কর হবে। হোটেলগুলোতেও একই অবস্থা। আমেরিকাতেও এই জিনিস চালু আছে কোথাও কোথাও। তবে কোনোখানেই এটা ঘোষণা দিয়ে করা হয় না। ঘটনাটা ঘটে নিঃশব্দে। আমার বন্ধু ফারুক সুপারস্টিশনে বিশ্বাস করেন না। আমিও করি না। করি না বলেই ১৩ তারিখেই মহাউচ্ছ্বাসে উচ্চারণ করতে পারি—হ্যাপি বার্থ ডে ফারুক ভাই। ১৩ আপনার জীবনকে দীপান্বিত করুক।
 

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ