|
পেছনে ফেলে আসি—১০: কিশোর বাংলার সম্পাদক দাদুভাই এবং
পিওন ওয়াজিউল্লাহ
-লুৎফর রহমান রিটন-
আমার সঙ্গে দাদুভাইয়ের সম্পর্কটা একেবারেই
অন্যরকম। একদা আমি তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলাম। কতো স্মৃতি তাঁকে ঘিরে!
দাদুভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা ছবি আছে, আশির দশকে হাটখোলা রোডের
সোনারগাঁও স্টুডিওতে তোলা। বিখ্যাত আলোকচিত্রি মনোয়ার হোসেন মানিক
ছিলেন এর ফটোগ্রাফার। ছবিতে,আমাদের দুজনার পোশাক ছিলো একই রকমের।
সম্প্রতি এই ছবিটা ছাপা হয়েছে ‘ছড়া পত্রিকা’য়, আমাকে নিয়ে প্রকাশিত
বিশেষ সংখ্যায়। চ্যানেল আইতে সাগর ভাইয়ের কক্ষে অভিনেতা আফজাল হোসেন
ছবিটা দেখেই উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠেছিলেন—‘দাদুভাই আর তোমার পরনে দেখছি একই
রকম শার্ট, এটা নিশ্চয়ই কোনো স্টুডিওতে তোলা? স্টুডিওতে এক সময় বিভিন্ন
সাইজের শার্ট-টাই-কোট ঝোলানো থাকতো!’
বাংলাদেশের ছড়ার ভুবনে রফিকুল হক একটি অনন্যসাধারণ নাম। তবে দাদুভাই
নামেই তাঁর পরিচিতিটা ব্যাপক। দৈনিক পূর্বদেশের ছোটদের পাতা ‘চাঁদের
হাট’-এর পরিচালক হিশেবেই তাঁর দাদুভাই নামধারণ। ছোটদের পাতা হিশেবে
‘চাঁদের হাট’ বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত হলে পরবর্তীতে সেই নামে একটি
শিশুসংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। স্বাধীনতার পর দেশের কিশোর-তরুণদের বিশাল
একটি অংশ ‘চাঁদের হাট’ নামের ব্যানারে এসে সমবেত হয়েছিলো এই দাদুভাইয়ের
নেতৃত্বে। অনেক তরুণ লেখকের জীবনের প্রথম লেখাটি পরম মমতায় ছেপে দিয়ে
তিনি লেখক হিশেবে তাদের বিকাশের পথটিকে কুসুমাস্তীর্ণ করে দিয়েছেন।
স্মরণে আনতে পারি ইমদাদুল হক মিলনের নামটি। মিলনের লেখা জীবনের প্রথম
গল্পটি ছাপা হয়েছিলো রফিকুল হক দাদুভাইয়ের হাত দিয়ে, দৈনিক পূর্বদেশে,
চাঁদের হাট নামের পাতায়।
ছড়াকার হিশেবে কী যে তুখোড় ছিলেন দাদুভাই! কৈশোরে পড়া তাঁর বেশ কিছু ছড়া
এখনও আমার স্মৃতিতে অক্ষয় অম্লান। ১৯৭০ সালে ভয়াবহ জলোচ্ছাসে লক্ষ লক্ষ
মানুষের সলিলসমাধি ঘটেছিলো তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে। জলস্রোতে ভেসে
যাওয়া উপকুলবর্তী মানুষদের নিয়ে কীর্তিমান ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই
তখন রচনা করেছিলেন অনবদ্য একটি ছড়া। ছড়াটি ছাপা হয়েছিলো পূর্বদেশের
পাতায়। অসামান্য সেই ছড়াটা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি--ছেলে ঘুমুলো বুড়ো
ঘুমুলো/ভোলা দ্বীপের চরে/জেগে থাকা মানুষগুলো/মাতম শুধু করে।/ঘুমো বাছা
ঘুমো রে/সাগর দিলো চুমো রে/খিদে ফুরুলো জ্বালা জুড়ুলো কান্না কেনো ছিঃ/বাংলাদেশের
মানুষ বুকে পাষাণ বেঁধেছি!’ কলকাতার আকাশবাণী থেকে একটি প্রতিবেদনে
প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এই ছড়াটি তখন
প্রচারিত হয়েছিলো।
দাদুভাই খুবই অলস প্রকৃতির মানুষ। স্টেশনে লাস্ট ট্রেন মিস করা লোকটির
মতো দাদুভাই সবখানেই লেট। দাদুভাইয়ের আলস্য নিয়ে বলতে গেলে কাহিনি শেষ
হবে না। এমনই আলস্য যে কোনো বইই ছিলো না তাঁর বহুদিন। বই হবে কী ভাবে?
প্রকাশিত লেখাগুলো সংগ্রহে থাকলে তো! মনে আছে, দাদুভাইয়ের একটা ছড়ার বই
প্রকাশিত হওয়া দরকার, এই তাগিদ থেকে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
তাঁর বেশ কিছু ছড়া আমি-ই যোগাড় করে দিয়েছিলাম তাঁকে। তারপর সেই ছড়াগুলো
দিয়ে তৈরি হয়েছিলো তাঁর প্রথম ছড়ার বই—‘বর্গী এলো দেশে’। প্রথম বইটি
তিনি নিজের খরচেই প্রকাশ করেছিলেন। পাণ্ডুলিপি তৈরি থেকে কম্পোজ-প্রুফ,
হাশেম খানের কাছ থেকে প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন বের করে আনা থেকে ব্লক
নির্মাণ এবং ছাপা ও বাঁধাই—সব কিছুতেই আমি এমন ভাবে যুক্ত ছিলাম যে
বাংলা একাডেমি প্রেসের অনেক কর্মচারীই মনে করেছিলো ওটা আমারই বই।
ওবায়দুল ইসলাম তখন বাংলা একাডেমির প্রেস ম্যানেজার। তাঁর এবং আফজাল
হোসেন নামের আরেক কর্মকর্তার অনেক সহযোগিতা পেয়েছিলাম তখন।
রফিকুল হক দাদুভাই তাঁর প্রথম বই ‘বর্গী এলো দেশে’র ভূমিকায় আমার
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন আমি তাঁর ‘ছায়াসঙ্গী’। বইটি প্রকাশিত
হয়েছিলো ১৯৮৬/৮৭ সালে। আমি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ কিংবা ‘কিশোর বাংলা’ কোনো
পত্রিকাতেই দাদুভাইয়ের সঙ্গে কাজ করিনি। চাঁদের হাটেও সার্বক্ষণিক
ছিলাম না। তাহলে আমি তাঁর ছায়াসঙ্গী হলাম কী করে! অথচ দাদুভাই ভুল
লেখেননি। আমি তাঁর ছায়াসঙ্গীই ছিলাম একদা। একটা সময় ছিলো যখন আমার
সকাল-দুপুর- বিকেল-রাত্রির সিংহভাগই আমি কাটাতাম দাদুভাইয়ের সঙ্গে।
সময়টা আশির দশকের সূচনাকাল। কিশোর বাংলা নামের পত্রিকাটি তখন অবজারভার
ভবন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও কিশোর বাংলা যাত্রা শুরু করেছিলো দৈনিক
বাংলা ভবন থেকে। দৈনিক বাংলা ভবনে কিশোর বাংলা পত্রিকাটির একজন সহকারী
সম্পাদক হিশেবে কর্মরত ছিলেন দাদুভাই। সে সময় তথ্যমন্ত্রী আকবর কবিরের
সহযোগিতায় দাদুভাই একটা ক্যু করে পত্রিকাটাকে নিয়ে গেলেন অবজারভার
হাউসে। এবং সেখানে তিনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং অচিরেই সম্পাদক
হিশেবে আবির্ভূত হলেন। দাদুভাইয়ের সম্পাদনায় কিশোরবাংলা পত্রিকাটি
অল্পদিনেই হয়ে উঠেছিলো বিপুল ভাবে পাঠকপ্রিয়। আমাদের শিশুসাহিত্যে
কিশোর বাংলার একটা উজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো বিশেষ করে মেধাবী তরুণ লেখকদের
জন্যে কিশোর বাংলা ছিলো একটা পরম মমতা আর ভালোবাসার প্লাটফর্ম।
দাদুভাই এবং কিশোর বাংলাকে নিয়ে আমার অনেক গল্প জমা হয়ে আছে স্মৃতিতে।
কিছু কিছু লিখবো এই সিরিজে। আশির দশকের শুরুর দিকে ১৯৮২ সালে,
ভালোবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে সাবলেট নিয়েছি
যাত্রাবাড়িতে। একটা চাকরির খুব প্রয়োজন। রফিকুল হক দাদুভাইকে ধরলাম।
দাদুভাই তখন সাপ্তাহিক কিশোর বাংলার সম্পাদক। আমাকে কথা দিলেন—একটা
কিছু ব্যবস্থা তিনি করবেনই করবেন। রোজ যাই মতিঝিল অবজারভার ভবনে, কিশোর
বাংলা অফিসে। দাদুভাইর সঙ্গে আমার দারূণ সখ্য। আমি তাঁর ছায়াসঙ্গী।
তাঁর সঙ্গে দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। আমি তাঁর অলিখিত এসিসট্যান্টের
মতো। যেটা বলেন করে দিই। লিখে দিই। কিশোর বাংলার বহু সম্পাদকীয় আমার
লেখা। কেউ সেটা জানতো না। জানতো কেবল পিওন ওয়াজিউল্লাহ। কৈশোর উত্তীর্ণ
সদ্য যুবা, নোয়াখাইল্লা। প্রেসে লেখা পাঠাবার শেষ দিনের শেষ মুহুর্তে
ওয়াজিউল্লাহ এসে চ্যাঁচামেচি শুরু করতো—এডিটোরিয়াল তো দিলেন ন দাদুভাই!
দাদুভাই একটা বিষয় নির্বাচন করে আমাকে বলতেন লিখে দিতে। আমি চটজলদি
লিখে দিতাম। খুশিমনে ওয়াজিউল্লাহ সেটা নিয়ে চলে যেতো কম্পোজ সেকশনে।
ওয়াজিউল্লাহ ছেলেটাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। দাদুভাই তাঁর বস হলেও
দাদুভাইকে সে রীতিমতো ধামকির ওপরে রাখতো। বিশেষ করে ‘প্রীতি নিও’
বিভাগের চিঠিপত্রের জবাবের পাতাটা নিয়ে তিনি খুব ভোগাতেন
ওয়াজিউল্লাহকে। পুরো পত্রিকা রেডি—বাকি শুধু প্রীতি নিও-র দুটি বা একটি
পৃষ্ঠা। তখন, সেলোফিন পেপারে মেকআপ করা পাতার একটা প্রিন্ট বের করা
হতো। ফিনফিনে ট্রান্সপারেন্ট সেলুফিন পেপারে কালো কালিতে ছাপা হতো
ম্যাটারটা। সেই পাতাগুলো পেস্টিং করে সেটা থেকে বানানো হতো প্লেট এবং
তারপর ছাপা। দাদুভাই খুবই অলস প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সিডিউল অনুযায়ী
দুপুরের মধ্যে মেক আপ শেষ করে বিকেলে পেস্টিং এবং পেজ রিলেশন হবে।
তারপর সন্ধ্যা থেকে ছাপা শুরু হবার কথা। সেদিন দুপুরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে
দাদুভাই বেরিয়ে গেলেন। বেরুনোর সময় দরোজা আটকে দাঁড়ালো
ওয়াজিউল্লাহ—ফ্রিতি নিও না দি কই যান আম্নে?
দাদুভাই কপট রাগ দেখালেন—আরে বাবা আমাদের খাওয়ার সময়টা দিবি তো! বাদশা
হোটেলে চারটা খেয়ে আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি। এসেই লিখে ফেলবো প্রীতি
নিও-র ম্যাটারটা। আমি ডিকটেশন দেবো রিটন লিখে ফেলবে তাতে এক ঘন্টার
মধ্যেই কাজ শেষ হবে। তুই কোনো চিন্তা করিস না বাপ!
‘মনে থায়ে য্যান’—বলতে বলতে পথ ছেড়ে দিলো ওয়াজিউল্লাহ।
বাইরে লাঞ্চ করে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা সেরে পান চিবুতে চিবুতে আমাকে
সঙ্গে নিয়ে অবজারভার ভবনের কিশোর বাংলা অফিসে দাদুভাই যখন ঢুকলেন তখন
সন্ধ্যা পেরিয়েছে। অফিসে আর কেউ নেই। দাদুভাই তাঁর রুমে ঢুকেই
‘ওয়াজিউল্লাহ আসার আগেই ম্যাটারটা রেডি করতে হবে’ বলতে বলতে
নিউজপ্রিন্টের প্যাড আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর আয়েসী ভঙ্গিতে চিঠির
স্তুপ থেকে একেকটা খাম খুলে তার ভেতর থেকে কিশোর বা কিশোরীর চিঠিটা বের
করে ওই চিঠির প্রেক্ষিতে খুবই আদুরে ভাষায় জবাব বলতে শুরু করলেন মুখে
মুখে। আর এদিকে আমি দ্রুত সেটা টুকে ফেলছি নিউজ প্রিন্টের প্যাডে।
দুতিনটে ছেলেমেয়ের উদ্দেশে বলা ডিকটেশন নিতে নিতেই দেখলাম পিওন
ওয়াজিউল্লাহ ঢুকলো। ওয়াজিউল্লাহকে দেখে দাদুভাই অতিরিক্ত ব্যস্ততার
ভঙ্গিতে অপরাধীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন—এই যে হয়ে গেলো বলে। তুই
আমাদের দু’জনকে দুকাপ চা দেতো বাপ!
--‘ছা হইত নো’ বলতে বলতে ওয়াজিউল্লাহ প্রস্থানে উদ্যত হলে দাদুভাই
ডাকলেন—আরে বাবা ম্যাটারটা নিয়ে যা।
‘লাইগত নো’ বলে ওয়াজিউল্লাহ বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। দাদুভাই আমাকে চোখ
টিপলেন—আমার ওয়াজিউল্লাহ ক্ষেপেছে। ওয়াজিউল্লাহ স্বগতোক্তি
করলো—ফত্রিকা ছাফা শুরু অই গেছে আর হেঁতি আইছে ফ্রিতি নিও লেইখতো...
দাদুভাই বিস্মিত—পত্রিকা ছাপা শুরু হয়েছে মানে? ‘প্রীতি নিও’ ছাড়া
কীভাবে বেরুবে পত্রিকা?
দরোজা অতিক্রমের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ডানদিকে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দিকে
তাকিয়ে ওয়াজিউল্লাহ বললো
--আম্নের ফ্রিতি নিও-ও দিয়ি দিছি।
--তুই কীভাবে প্রীতি নিও দিলি? আমি তো লিখি-ইনি!
--কইলাম তো টেনশন নিয়েন্ন। আঁই দিয়ি দিছি। এহন আন্নেরা বাইর অই যান।
রুমে তালা মাইত্তে অইব।
চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ওয়াজিউল্লাহকে পাকড়াও করলেন দাদুভাই—রাগ করিস না
ভাই। এক্ষুণি হয়ে যাবে।
অতঃপর ওয়াজিউল্লাহ হাসতে হাসতে যে কাহিনি বয়ান করলো তাতে আমিও ভড়কে
গেলাম। তখন ঘড়িতে রাত আটটা। সন্ধ্যা সোয়া সাতটা পর্যন্ত আমাদের জন্যে
অপেক্ষা করেছে সে। প্রেস থেকে তাড়া দিচ্ছিলো বারবার। ছাপার সিডিউল মিস
করা যাবে না। কোনো উপায়ন্তর না দেখে শেষমেশ অনেক পুরনো সেলুফিনের
বান্ডিল থেকে ‘প্রীতি নিও’ বিভাগের দুটি পাতা কেটে নিয়ে পেজ রিলেশনের
টেবিলে দিয়ে এসেছে ওয়াজিউল্লাহ।
শুনে দাদুভাই হায় হায় করে উঠলেন।
ওয়াজিউল্লাহ খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো—কেউ বুইঝত নো।
(পুনশ্চ/ওয়াজিউল্লাহ ঠিকই বলেছিলো। আসলেই কেউ কিছুই বোঝে নি...!)
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|