[প্রথমপাতা]
|
যে জীবন হয়নি যাপন
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
সৈকতে ভেজা বালুর উপর দু’হাটু অর্ধভাজ করে বসে আছে সিমানা ।দৃষ্টি তার চলে
গেছে সামনের বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে আরো অনেক দূরে ।যতই দূরে যাক,সমুদ্রের
সিমানা পেরিয়েও তার দু’চোখের দৃষ্টি শুধু সমুদ্রকেই দেখছে ।জগতের এ যেন এক
অপূর্ব সৃষ্টি!এত বিশালতা,এত গভীরতা,এত প্রাণবšত:অথচ কী নির্মল শাšত,এত
গর্জন ,তারপরও কি মহামায়া,কী শুভ্রতা,কী শুদ্ধতা নিয়ে একের পর এক ঢেউ এসে
আছড়ে পড়ছে কিনারায়!সমুদ্রের চেয়ে সুন্দর কোনকিছু যে থাকতে পারে এমূহুর্তে
সিমানার কাছে এটা অবিশ্বাস্য ।
ভেজা বালুর উপর দু’ পায়ের পদচিহ্ণ একে একে অনুরাগ এসে সিমানার পাশে বসল
।তখনো সিমানার দু চোখের দৃষ্টি বাঁধা পরেছিল ঐ দূর ঢেউয়ের মিছিলের প’রে
।অনুরাগ সিমানার মগ্নতায় বিঘœ না ঘটিয়ে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল সিমানার পানে ।
এই সমুদ্রের কাছে এসে সিমানা যেন আরও অপরূপা হয়ে উঠেছে । ।আগে শুনেছি,
সমুদ্রের লবনাক্ত পানি আর সূর্যের তপ্ত রোদের অতি বেগুনী রশ্মির কারনে
এখানে এলে নাকি সকলের গায়ের রং ময়লা হয়ে যায় ।অথচ সিমানাকে কেন জানি আরো
শুভ্র, আরো স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে ।এই পড়šত বিকেলে হেলে পড়া সূর্যের সোনালী
কিরণ এসে পড়ছে সিমানার গায়ে ।সূর্যের সাথে সাথে সিমানাও যেন সোনালী রং ধারণ
করছে ।কি অপূর্ব!
সিমানা অনুরাগের উপস্থিতি টের পেল ।কিšতু দৃষ্টি তার তখনো সামনের বিশাল
জলরাশির প’রে ।
অনুরাগ জিজ্ঞেস করল,কি দেখছ অমন করে?
-দেখছি জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ।আনমনে সিমানা বলল,অপূর্ব!
-আমিও দেখছি । জগতের সবচেয়ে সুন্দর ,সবচেয়ে মোহনীয় সৃষ্টি ।অপূর্ব !
-তাইনা বলো?এখন আফসোস হচ্ছে,প্রকৃতির এই অপরূপ আর মনোমুগ্ধকর স্থানে আরো
আগে কেন এলামনা ।
অনুরাগ সীমানার দিকে দু’চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে মৃদুস্বরে বলে,আমিও ভাবছি,
এত সৌন্দর্য্য যে তোমার মাঝে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলে, তা আগে কেন আমি দেখতে
পেলামনা ।
সিমানা পাশ ফিরে দেখে অনুরাগ অপলক দৃষ্টিতে তারই দিকে চেয়ে আছে ।
সিমানা বলল,তুমি কোন সৌন্দর্যের কথা বলছ?
-কেন ?এইযে আমার সামনে তুমি বসে আছো জগতের সবচেয়ে সুন্দরীতমা
,অনন্যা,অপরূপা.....
প্রশংসায় অনুপ্রানীত হয়ে সিমানা বলল,হয়েছে।অনেক বেশী বলে ফেলেছ ।কোথায় তুমি
আমার পাশে বসে সম,ুদ্র দেখবে;তা না করে তুমি কিনা....
সমুদ্র দেখাটাতো তোমার স্বপ্ন ছিল ।আর আমার স্বপ্ন ছিল তোমার স্বপ্ন পূরণ
করা ।যদিও এটা করতে আমার অনেক সময় লেগে গেছে ।সেজন্য আমি দু:খিত ।তোমার
স্বপ্নের সমুদ্রের কাছে আরো আগে নিয়ে আসতে পারিনি তোমাকে ।
তুমি কেন দু;খিত হবে?তুমিতো আমার সব স্বপ্নই পূরণ করেছ ।তুমি আমার পাশে না
থাকলে আমি হয়তো মরার অনেক আগেই মরে যেতাম ।তুমি আমাকে দিয়েছ বেঁচে থাকার
অনুপ্রেরনা ।নইলে এ অবস্থায় আমি এখনো টিকে আছি!আরও অনেকদিন আগেই আমি এই
দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বসে ছিলাম ।বেঁচে থাকার কোন
অবলম্বন ছিলনা,কোন আশা ছিলনা ।সবাই আমাকে ত্যাগ করেছিল ।
সিমানার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠলো। বলল,
আমি যাদেরকে আপন ভাবতাম তারা সবাই দুর্দিনে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল ।আর
তুমি ,যাকে আমি দু:সময়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নের দোহাই দিয়ে ,এক
বিশ্বাসঘাতক পিতার মিথ্যা আশ্বাসের লোভে পড়ে চলে গিয়েছিলাম দুর্দেশে।সেই
তুমিই এখন আমার পাশে।
এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই সেসব দিনগুলো।তুমি তখন নি:সঙ্গ জীবনের বিশাল
একাকীত্বের মাঝে আমার এতটুকু সঙ্গ পাওয়ার জন্য কতবার আমাকে ফিরে আসতে
বলেছিলে ।আমি তোমার কথা তখন এতটকুও ভাবিনি ।আমিযে কত বড় স্বার্থপরের মত কাজ
করেছিলাম সেটা ভাবতেই এখন আমার নিজের উপর ঘৃনা হয় ।তোমার কথা যে একেবারে
ভাবিনি তা নয় ,যা ভেবেছিলাম তা ছিল আমার ভুল ভাবনা ।আমি ভেবেছিলাম তুমি
হয়তো আমার সাফল্যকে ঈর্ষা করে আমাকে বারবার দেশে ফিরে আসতে বলছ,যাতে আমার
স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায় । তখন একটুও বুঝিনি একাকীত্বের কী ভীষণ যন্ত্রনা !আর
যখন বুঝতে পেরেছি তখন লজ্জিত হবারও ভাষা খুঁজে পাইনি ।এই সমুদের মধ্যে
নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারলে হয়তো আমার প্রায়শ্চিত্য হতো ।
অনুরাগ বলল,শুধু শুধু এসব মনে করে কেন সূর্যা¯েতর এই অপরূপ দৃশ্যটা মিস করছ
।
ফেলে আসা দু:সময়ের ঘটনা মনে করে বর্তমান সু-সময়কে বিষন্ন করার কোন মানে
হয়না ।ওসব না ভেবে বরং এটা কেন ভাবছনা যে,তুমি আর আমি এই বিশাল সমুদ্রের
পাশে বসে আছি ,একের পর এক ঢেউ এসে আমাদের পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে,মাথার উপর
সীমাহীন নীল আকাশের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্তিম লালিমা ,সামনে অ¯েতর পথে
যাওয়া লাল টুকটুকে সূর্য ।এর চেয়ে সুখের কোন মূহুর্ত কি আছে এই জগতে? বলে
সীমানার বা হাতটি নিজের দু ’হাতের মধ্যে চেপে ধরল অনুরাগ ।অনুরাগের কাঁধের
উপর সীমানা নিজের মাথাটি এলিয়ে দিল ।এখন সত্যিই মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুখকর
যদি কোন মূহুর্ত আসে সেদিন হয়তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ।কারণ পৃথিবীর সেই
সুখ সহ্য করার ক্ষমতা থাকবেনা ।
সামনে একখন্ড বিশাল লাল সূর্য ।যেন সমুদ্রের টানে এর গভীরে নিজেকে বিসর্জন
দেয়ার জন্যই এত দুনিয়া ঘুরে শেষ পর্যšত এই সমুদ্রের মাঝে ডুবে যেতে এসেছে ।
দুজন মুগ্ধ হয়ে দেখছে লাল টুকটুকে সূর্যের অ¯ত যাওয়া ।
তিনদিন হল ওরা এসেছে কক্সবাজার ।তিনদিনই সূর্যা¯েতর এই সময়টা দু’জন নিভৃতে
এই সৈকতে বসে অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করছে ।সমুদ্রে বেড়াতে আসার এটাইতো
স্বার্থকতা।
সিমানা বলল,দেখছ সূর্যটা কি ভীষণ লাল !লাল রং এর এমন নিবিড় গাঢ় প্রভা আমি
এর আগে কখনো দেখিনি । এখানে সূর্যটাকে কত কাছে মনে হয় ।মনে হয় যেন হাত
বাড়ালেই ছুঁতে পারব । এতবড় জলরাশির মধ্যে দিয়ে সূর্যের ঐ লাল কিরণ টলমল করে
ঐ সূর্যের কাছ থেকে একেবারে আমার পায়ের উপর এসে পরেছে ।ইচ্ছে করছে এই নরম
লাল আলোর গালিচায় পা ফেলে ফেলে ঐ সূর্যের কাছে চলে যাই ।কত সুন্দর আমাদের
এই দেশ !এমন মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের দেশের ভেতরেই ছিল । অথচ আমরা
এখানে আসতে এত দেরী করেছি ।দেশের মধ্যে এত চমৎকার জায়গা রেখে আমরা বিদেশে
পাড়ি জমাই ।কি আশ্চর্য তাইনা বল?আমারতো ইচ্ছা করছে যতদিন বেঁচে আছি এখানেই
থেকে যাই ।বিশাল সমুদ্র দেখে দেখে কাটিয়ে দিব বাকী দিনগুলো । সমুদ্র আমাদের
অšতরের গহীন থেকে দু:খ-কষ্টগুলোকে বয়ে নিয়ে যায় ঐ দূর অসীম সীমানায় ।তাইতো
এখানে এলে আমরা ভুলে যাই মনের সম¯ত দু:খ-কষ্ট ।বেঁচে থাকার নিরলস বাসনা
জেগে ওঠে প্রাণে ।ইচ্ছে করে আরো অনšত কাল বেঁচে থাকি ; এমনি করে তোমার
কাঁধে মাথা রেখে - কাটিয়ে দেই যুগের পর যুগ । কি পারবেনা অনšত কাল আমাকে
বহন করতে?সীমানা অনুরাগের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করে উত্তরের জন্য
অপেক্ষা করে থাকল।
অনুরাগ বলল,কেন পারবনা ।তোমাকে নিয়ে আমি এই একটি জনম কেন, এমনি হাজারো জনম
কাটিয়ে দিতে পারব ,তোমার কি আমার উপর ভরসা নেই?দেখতে চাও পারি কিনা ?
আমি জানি তুমি পারবে।সবকিছু ফেলে শুধু আমাকে নিয়ে এখানে সারাজীবন থাকতে
পারবে তুমি,এটা আমার বিশ্বাস।কিন্তু আমি তোমাকে আর সে কাজ করার সুযোগ দিবনা
।এমনিতেই তুমি যা করেছ...
-হয়েছে ।আর বলতে হবেনা ।চলো এখন ওঠা যাক ।সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ হল
।ঢেউয়ের সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাস আসছে ।আজ তোমার গায়ের চাদরটা সাথে করে আনা
হয়নি । এখন আর বসতে হবেনা ।শেষে শরীর খারাপ করবে ।
উঠতে উঠতে সীমানা বলল,শরীরের আর খারাপ হওয়ার বাকী কি আছে ।আমি বরং এটাই
চাই, আমার মরনটা যেন এখানেই হয় ।তাহলে সেটা হবে আমার সুখের মরন ।এই অপার
সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে আঁখি বন্ধ করব ,আর খুলবনা ।তুমি আমাকে তোমার কোলে
শুইয়ে রাখবে ।বুঝতেও পারবেনা আমি কখন এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেলাম ।ভালো
হবেনা বলো?
অনুরাগ কোন জবাব না দিয়ে সীমানার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ।অত:পর সীমানার হাত
ধরে ধীরে ধীরে হোটেলের দিকে রওনা হল ।দু/চারপা এগিয়ে সীমানা নিজের হাতখানি
ছাড়িয়ে নিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ।
-কি ব্যপার, আসো ।
-অনুরাগ,আরো কিছুক্ষণ থাকিনা ?আজ কেন জানি আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা ।চলো
,একটা সিটে বসে আরো কিছুক্ষণ সমুদ্র দেখি ।দেখ আকাশে কি সুন্দর চাঁদ
উঠেছে।মনে হচ্ছে প্রকৃতির এতসব আয়োজন আজ আমারি জন্য ।জ্যোৎস্না রাতে সমুদ্র
দেখা ! কি যে ভালো লাগছে আমার!তুমি আমাকে যেতে বলনা প্লিজ ।প্রকৃতির এই
নান্দনিক সৌন্দর্য্যের সুধা আমাকে পান করতে দাও । প্লিজ থাকি আর একটু?
-ঠিক আছে ।তুমি যখন চাইছ অবশ্যই থাকব । তাহলে আমি গিয়ে তোমার চাদরটা নিয়ে
আসি ।তুমি এইখানটায় বসো ।থাকতে পারবেতো একা?
-হ্যাঁ পারব ।তুমি যাও ।
অনুরাগ চলে গেল । সিমানা সিটের উপর হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল
।
এখানে এসে সবকিছুই যেন অন্যরকম লাগছে ।এর আগে কত জ্যোৎস্না দেখেছে ।অথচ
চাঁেদর এমন রূপ,এত শোভা কখনো দেখেছে বলে মনে হয়না সিমানার ।পরিচ্ছন্ন
আকাশের সাথে লেপ্টে আছে একখন্ড রূপালী চাঁদ ।আর তার থেকে ছিটকে আসা ভেজা
স্নিগ্ধ রূপালী আলো এসে এই সমুদ্রের সৌন্দর্য্যকে আরো অনেক গুন বাড়িয়ে
দিয়ছে । ঢেউয়ের সাথে সাথে চাঁদের রূপালী আলোর দোল খাওয়া যেন কোন এক চির
যৌবনা তরুনীর নৃত্যের মতো সীমানার হ্্রদয়েও দোল দিয়ে যাচ্ছে ।সিমানার মনে
পড়ে সেই বিখ্যাত লাইনদুটি-
“এমন চাঁদের আলো
মরি মরি সেও ভালো,
এ মরন স্বর্গ সমান”।
অনুরাগ ধীরপায়ে এসে সিমানার গায়ে পশমী চাদরখানা জড়িয়ে দিয়ে পাশে বসতে বসতে
জানতে চাইল,কি একা ভয় পাওনিতো?
আরে না ,বরং আমি যে একা ছিলাম সেটাইতো আমার মনে ছিলনা ।আর আমিতো একা
ছিলামনা ।
-একা ছিলেনা মানে?
-মানে বুঝলেনা?বলে সীমানা ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলল,
আমার সাথে ছিল ঐ আকাশের চাঁদ,ছিল সমুদ্রের ঢেউ ,নির্মল বাতাস,হালকা
কুয়াশা,আরো কত কি।ওদের মাঝেইতো আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম ।আমিতো মুগ্ধ হয়ে
সমুদ্র আর জ্যোৎস্নার মাখামাখি দেখছিলাম ।জ্যেৎস্নার আলো ঐ সমুদ্রের বুকে
কিভাবে খেলা করে ,কত নিবিড় প্রেম বিরাজ করছে এ দুয়ের মাঝে ! যতই দেখছি ততই
মুগ্ধ হচ্ছি ।এত দেখছি তবুও মন ভরছেনা।
অনুরাগ সিমানার কাছে কিছু খাবে কিনা জানতে চাইল ।সিমানা বলল ,কফি খাওয়া
যেতে পারে ।এমনিতেও শীত শীত লাগছে ।
-বেশী শীত লাগলে চল রূমে ফিরে যাই ।তোমার আবার...
-আরে না ,বসোনা তুমি স্থির হয়ে । সারাক্ষণ শুধু আমাকে নিয়ে ভাবনা ।এটুকুন
শীত লাগছে তো কি হয়েছে?আরো তো কত মানুষ রয়েছে এখানে ।বেড়াতে এলে একটু অনিয়ম
হবেই ।তাই বলে ঘরের মধ্যে বসে থাকলে কি হবে?মাথার উপর বিশাল আকাশের সাথে
লেপ্টে থাকা ঐ চাঁদ, আর সম্মুখে ঢেউয়ে ঢেউয়ে আছড়ে পড়া সমুদ্রের গর্জন,এমন
সৌন্দর্য্যরে মিতালী হোটেলের রূমে বসে কি উপভোগ করতে পারতাম বলো?
-আচ্ছা ভাই ঠিক আছে বসছি তোমার সাথে ।এখন খুশি তো?
-হু,
সিমানা অনুরাগের কাঁধের উপর নিজের মাথাটি রেখে চুপ করে রইল ।
একটু পরে সিমানা ডাকলো-
অনুরাগ।
-হু।
-কি ভাবছো তুমি?
-হুম,কিছুনা।
-তাহলে চুপ কেন?কিছু বলো।
-কিছু বলতে ইচ্ছা করছেনা ।তুমি বলো ।আমি শুনছি ।
-কেন ,তোমার কথা কি ফুরিয়ে গেছে ?
-না,তা কেন ফুরাবে?আর কথাতো তুমিই সব সময় বলো,আমি শুনি।
-তাহলে তুমি একটা গান গাওনা প্লিজ ।
-গান? না,ভাই,আমাকে গান গাইতে বলোনা ।আর আমি গাওয়া শুরু করলে এই সৈকতের সব
মানুষ দৌঁড়ে পালাবে ।
-না ,তোমাকে গাইতেই হবে ।আর আমি জানি তুমি অতটাও পঁচাও গাওনা ।আগে তুমি
আমাকে কত গান শোনাতে ।
-হ্যা,তখন সেখানে শুধু তুমি আর আমিই থাকতাম ।আমি খারাপ গাইলেও তুমি ছাড়া
কেউ শুনতনা ।কিšতু এখানে...
-তুমি আবার কবে থেকে মানুষের কথার পরোয়া করতে শুরু করেছ?আর ওসব বাহানা
চলবেনা ।শুরু করো ।
হা, ঐ গানটা গাও ।ঐ যে একটা গান আছেনা....ও কারিগর দয়ার সাগর ,আমার
.....তার পরে যেন কি?ঐ যে ঐ লাইনটা আছেনা,চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরন হয়
?অনেক দিন শুনিনা,তাই গানের কথাগুলো ভালকরে মনে করতে পারছিনা।
-এটাতো টুটুলের গান ।গানটা আমারও অনেক প্রিয় ।কিšতু ওর মত করে তো গাইতে
পারবনা ।শুধু তুমি বলছ বলে গাইছি ।
অনুরাগ গানটির কয়েকটা লাইন গাইল ।তারপর আর মনে আসছেনা বলে ছেড়ে দিল ।
সিমানা বলল,তুমি মিছে মিছেই লজ্জা করছিলে ।দেখলেতো এখনো কত ভাল গাও তুমি
?আমিতো বাংলা গান শোনা ছেড়েই দিয়েছিলাম ।তোমার সাথে দেখা হবার পর থেকে আবার
বাংলা গান শুনছি ।সেজন্য সব সময় সব গানের কথা মনে আসেনা ।তুমিতো একসময় অনেক
ভাল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে । এখন আর গাওনা ?
অনুরাগ বলে,গাই মাঝে মাঝে ।তবে এখন অনেক ব্য¯ত থাকিতো ।যখন মনটা খুব খারাপ,
কিংবা খুব ভাল থাকে ,তখন নিজের মনে গুন গুন করে গাই ।
এখন একটা গাওনা রবীন্দ্রসংগীত। আকাশে চাঁদের আলো,সম্মুখে বিশাল সমুদ্রে
ঢেউয়ের নাচন,তুমি আর আমি এই সৈকতে বসে আছি । তার সাথে একটা রবীন্দ্রসংগীত
হলে ভীষণ মানাবে বলো?
তুমি যখন বলছো আমার একটা পছন্দের রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার চেষ্টা করছি ।
“ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লেখ তোমার মনেরও মন্দিরে.”..অনুরাগ এই
গানটি গেয়ে চুপ হয়ে রইল ।অনেকক্ষণ দুজনে কোন কথা বললনা ।
খানিক বাদে সিমানা বলল,অনুরাগ ,তোমার এই গানটি আমার হ্্রদয় ছুঁয়ে গেল
।কথাগুলি এত সুন্দর!
সিমানা দেখল অনুরাগ কোন কথা বলছেনা ।সিমানা জানতে চাইল,অনুরাগ তোমার কি
হয়েছে?
হু,কিছুনা ।
তাহলে কথা বলছনা কেন?
এমনি ।তুমি বল ,আমি শুনছি ।
না ,আমার মনে হয় তোমার কিছু একটা হয়েছে ।
কিচ্ছু হয়নিতো ।আমার আবার কি হবে?বলে অনুরাগ মোবাইলে সময়টা দেখে বলল,
ওহ,আটটা বেজে গেছে ।তোমাকে এখন ওষুধ খেতে হবে । অনুরাগ নিজের পকেট থেকে
ওষুধের একটি পাতা বের করে সেখান থেকে একটি সিমানার হাতে দিল ।
সিমানা বলে,অনুরাগ তুমি এটাও নিয়ে এসেছ?এতসব তোমার মনে থাকে কিভাবে? আমার
জন্য তোমাকে কতই না ভাবতে হয় ?আর সেটা ভেবে ভেবে আমার সারাক্ষণই নিজেকে
অপরাধী মনে হয় ।
তাহলে সারাক্ষণ সেটা না ভাবলেইতো হয় ।তোমার জন্য তো আমি কিছু করিনা।আমি
আমার জন্যই এসব করি ।তুমি ভাল থাকলেতো আমারই লাভ ।
সিমানা বলে,জানি তোমার কি লাভ ।এসব আমাকে খুশি করার জন্যই বলছ ।আমি তোমার
সময় ,অর্থ সবই অপচয় করছি ।বিনিমিয়ে তোমাকে কিছুই দিতে পারছিনা ।
অনুরাগ বলে,কোথায় কিছু দিতে পারছনা?তুমি আমার জীবনে এসে তো আমার জীবনটাই
কানায় কানায় ভরিয়ে দিলে । যে আমি কিছুদিন আগেও ছিলাম একা ;তোমার আগমনে এখন
আমি পরিপূর্ণ ।একাকী জীবন আমার অসহনীয় হয়ে উঠেছিল ।প্রতিটি মূহুর্ত আমি
বিষন্নতায় কাটিয়েছি ।সেসব দিনের কথা মনে পরলে এখনো আমার কান্না পায় ।আমার
আত্মীয়-স্বজনরা বলত,পুরুষ মানুষ এত ভেঙ্গে পড়লে কি চলে ?কিšতু আমি কেন জানি
বেঁচে থাকার সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম ।কার জন্য বেঁচে থাকব,কি নিয়ে বেঁচে
থাকব ;এসব ভেবে যখন ক’ল কিনারা পাচ্ছিলামনা,তখন একবার আত্মহত্যা করতে
গিয়েছিলাম ।কিšতু সেখানেও আমি ব্যর্থ হলাম ।
সেদিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনা ।একটি সড়ক দূর্ঘটনা আমার পরিবারের সবাইকে
কেড়ে নিয়েছিল । দুর্ঘটনার পর আমার মা সাতটি দিন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর
সাথে লড়াই করে অবশেষে সকল যন্ত্রনার অবসান ঘটিয়ে আমাকে একা করে দুনিয়া থেকে
বিদায় নিয়েছিলেন ।সবাইকে হারিয়ে নিজেকে এ বিশ্ব সংসারে বাঁচিয়ে রাখা
অপ্রয়োজনীয় মনে হল। সেদিন মাত্র কয়েক হাত দূরে ছিল ট্রেনটি । মায়ের সেই
যন্ত্রনা ভরা দিনগুলির কথা মনে পরতেই রেল লাইন থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়েছিলাম
।আমি এমনি মূর্খ,আত্মহত্যাও আমার দ্বারা হয়নি।
তারপর থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করছি ।আর তখনি তুমি ফিরে এলে
আমার জীবনে ।এখন সব দু:খ ভুলে তোমাকে নিয়ে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার
স্বপ্ন দেখছি ।
অনুরাগের কথা শুনতে শুনতে সিমানার চোখে পানি এসে গেল ।সিমানা বলল,সেইতো আমি
এলাম,একেবারে শূন্য হাতে!সব কিছু হারিয়ে শুধু নিজেকেই নিয়ে এলাম ।আর শরীরের
মধ্য করে আনলাম লক্ষ-কোটি মরন বিষ ।যা থেকে কোন কিছুতেই আমার মুক্তি
মিলবেনা ।আমার কোন পরিত্রাণ নাই।মৃত্যুই আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্য।
অনুরাগ,তোমাকে আমি অনেক ঠকিয়েছি,এখনো ঠকাচ্ছি ।তুমি এখনো কেন আমাকে আগলে
রাখতে চাইছ? আমিতো তোমাকে এই মরন বিষ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবনা ।আমার সাথে
জড়িয়ে উল্টো তোমার জীবনটাও নষ্ট করে ফেলতেছ ।সমাজে অনেকেই এজন্য তোমাকে
প্রত্যাখান করেছে ।তুমি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরছ,তা কি তুমি অনুভব করতে
পারছনা অনুরাগ?
অনুরাগ বলল,তুমি ছাড়া আমার আর আছে কে ?আর লোকের পড়োয়া আমি যে করিনা তাতো
তোমার অজানা নয় ।আমার মন যা বলে আমি সব সময় তাই করি, আর তাই করব ।
কিন্তু আমিওতো তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম ।তুমি যখন একা হয়ে গিয়েছিলে,যখন
তোমার পাশে আমার থাকার প্রয়োজন ছিল,তুমি বারবার আমাকে ফিরে আসার কথা
বলছিলে, তখন আমি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এতটাই ব্যা¯ত ছিলাম যে তোমার
অবস্থাটি আমি অনুভব পর্যšত করিনি ।আমি তখন শুধু সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে
উঠতেই ব্য¯ত ছিলাম ।হাত বাড়ালেই আমি সুখের ছোঁয়া পেতে পারতাম ।কিšতু আমি
তখন সুখের প্রকৃত অর্থই বুঝতে পারিনি ।যা অতি সহজেই পেতে পারতাম তাকে নিজেই
দূরে ঠেলে দিয়েছি । ।রাতারাতি সবকিছু অর্জনও করেছিলাম ।কিন্তু অর্থ আর
খ্যাতিই যে জীবনে সবকিছু নয় ,একটি জায়গায় এসে আমি হারে হারে তা টের
পেয়েছিলাম ।আধুনিকতার পেছনে উম্মাদের মত ছুটে চলেছি। প্রকৃত আধুনিকতার
ধারণাই ছিল আমার কাছে অস্পষ্ট র্। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম অনুরাগ।আধুনিকতার
স্থলে বেপরোয়া জীবন-যাপনে অভস্থ্য হয়ে পড়েছিলাম ।আমাকে শাসন করারও কেউ
ছিলনা ।তাই নিজের জীবনটাকে একেবারে ধ্বংসের শেষ প্রাšেত নিয়ে এসেছিলাম অতি
অল্প সময়েই ।যার প্রায়শ্চিত্য করারও এখন আমার সুযোগ নেই ।তোমার সাথেও আমি
প্রতারনা করেছি ।আর আজ তোমার অনুগ্রহেই বেঁচে আছি ।এর চেয়ে আর কঠিন লজ্জা
আর কি হতে পারে? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই সমুদ্রের মাঝে ঝাঁপ দেই ।তাতে যদি
আমার প্রায়শ্চিত্য হয় ।
একটু থেমে সিমানা আবার বলল,যে অর্থ আর খ্যাতির পেছনে ছুটেছিলাম আজ সবকিছুই
আমার কাছে অর্থহীন ।“সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যে মানুষের ভালবাসা”, জীবনের এই
ক্রাšিত লগ্নে এসে আমি আজ অনুধাবন করতে পেরেছি ।
অনুরাগ,তুমিতো জানো আমার পক্ষে আর কোনদিনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব
নয় ।এ দুনিয়াতে আমি আর মাত্র কয়েক দিনের অতিথি ।যে কোন মূহুর্তে আমি চলে
যাব ।তোমার তখন আরো কষ্ট হবে ।তুমি আবার একা হয়ে যাবে ।সে কথা ভাবতেই আমার
ভীষণ কষ্ট হয় ।তুমি কিভাবে সামলে নিবে নিজেকে ?
অনুরাগ বলল, আমাকে নিয়ে ভেবনা । আললাহ্ আমাকে অনেক ধৈর্য্য শক্তি দিয়েছেন
।এখন আমি সকল দু:খ-কষ্টের উর্ধ্বে ।কোন কিছুই আর আমাকে বিচলিত করতে পারবেনা
।সেজন্যইতো সবকিছু জেনে শুনেও তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি ।যতদিন বেঁচে থাকব
অন্যের জন্য বাঁচব ।“অন্যের প্রয়োজনে যদি নিজেকে একটুও কাজে লাগাতে পারি
তবেই নিজেকে স্বার্থক ভাববো ”।
“যে মানুষ একদিনের জন্যও আমাকে ভালবেসেছে ,আমি আজীবন ভালবাসা দিয়ে তার ঋণ
শোধ করতে চেষ্টা করব ”।তোমার কাছ থেকে আমি কি পেলাম -–কি পেলাম না সেটা
ভেবেতো তোমাকে আমি একলা ছেড়ে দিতে পারিনা ।আমি তোমাকে আগেও যেমন ভালবাসতাম
এখনো ঠিক তেমনি ভালবাসি ।তোমার অনুপস্থিতি আমাকে নি:সঙ্গ করেছে ঠিকই,
কিন্তু,তোমাকে আমি হ্্রদয় থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করিনি ।তোমার পরিবর্তে এই
হ্্রদয়ে অন্য কারো জন্য ভালবাসাও সঞ্চারিত হয়নি ।তুমি ছিলে কি ছিলেনা সেটা
কখনো ভাবিনি ।ভেবেছি এটাই যে,আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি ,আর আমার অন্তরে
শুধু তুমিই আছো,শুধুই তুমি।আজীবন তাই বেসে যাব ।তুমি দুনিয়াতে থাক কিংবা না
থাক ভালবাসাতো তার জন্য বসে থাকবেনা ।
সিমানা,অনেকতো কথা হল ,এবার চল ফিরে যাই ।আর অনেক ঠান্ডা বাতাস বইছে
।তাছাড়া খাবারও সময় হয়েছে ।
সিমানা বলল,অনুরাগ আজ আমি তোমার অবাধ্য হব ।আজ সারারাত আমি এখানেই থাকব বলে
ঠিক করেছি ।আমার মনটা আজ কেমন অস্থির লাগছে ।জানি রাতে ঘুমও হবেনা ।একা একা
রুমে থাকলে আরো খারাপ লাগবে ।অস্থিরতা আমাকে আরো অসু¯্য’ করে ফেলবে ।তার
চেযে বরং এই খোলা আকাশের নিচে ভরা জ্যোৎস্নায় সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে নিজের
মনটাকেও ভাসিয়ে দেই ঐ দূর সীমানায় ।তাতে যদি মনটা একটু হালকা হয় ।
অনুরাগ বলল,সারারাত এখানে থাকা কি তোমার ঠিক হবে?তোমার গায়ের জ্বর এই
ঠান্ডায় আরো বেড়ে যেতে পারে ।তাছাড়া রাতের খাবার খেতে হবেনা?
সিমানা বলল,খেয়ে নেব একটা কিছু ।তুমি ভেবনা ।একরাত খোলা আকাশের নিচে থাকলে
কি আর এমন হবে?আর যদি কিছু হবার থাকে তাতো হবেই ।ঘরে থকলেও হবে, বাইরে
থাকলেও হবে ।
-তোমার যদি ঘুম না আসে আমি না হয় তোমার ঘরে থেকে তোমার সাথে গল্প করে
সারারাত কাটিয়ে দিব ।তবুও এই শরীরে তোমার এখানে থাকা ঠিক হবেনা ।
সিমানা ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলল, তুমি আজ কিছুতেই আমাকে এখান থেকে
নিয়ে যেতে পারবেনা ।সুতরাং এই নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বরং আসো এই সুন্দর
মূহুর্তটাকে উপভোগ করি ।
অনুরাগও শেষ পর্যšত সিমানার কথাই মেনে নিতে বাধ্য হল ।
কখনো কথা ,কখনো গান কখনো কখনো অতীতের স্মৃতি রোমন্থন,আর কখনো নিশ্চুপ হয়ে
সমুদ্রের গর্জন শোনা ; এই ভাবে সুখ-দ:ুখের স্মৃতির সাথে দুজনে কাটিয়ে দিল
রাতের বেশ খানিকটা প্রহর ।এর মাঝে এটা-ওটা খেয়ে নিল ।মাঝে মাঝে কফি তো আছেই
।এখানের ছেলেগুলি দারুণ কফি বানায় ।আর একটা ছেলের কফি বানানোর প্রশংসা করায়
সেতো দিগুণ উৎসাহের সাথে বারবার এসে সিমানা ও অনুরাগকে কফি বানিয়ে দিয়ে যায়
।
রাত যখন বারটা পেরিয়ে ঘড়ির কাটা আরো খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন একবার অনুরাগ
সিমানাকে বলে, সিমানা তোমার কি একটুও ঘুম আসছেনা?
-না,আমার মনে হয় আজ সারারাতেও ঘুম আসবেনা ।আর কি দরকার ঘুমের ?এইতো ভাল আছি
।লন্ডনে এমনি কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি !এসব আমার সয়ে গেছে ।আর আমিও
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতে চাইনা ।যেটুকু সময় আছি জেগে থেকে সবকিছু
উপভোগ করে যেতে চাই ।তাতে মরে গিয়েও আফসোস থাকবেনা ।কি ঠিক বলিনি?
অনুরাগ বলে,কিšতু আমার যে ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ।
- তোমার ঘুম আসলে তুমি এখানে ঘুমাও না?তুমি ঘুমিয়ে থাকো ।অসুবিধা কি? আমিতো
জেগেই আছি ।
আমি ঘুমাবো আর তুমি একা একা জেগে থাকবে?তোমার ভাল লাগবেনা ।ঠিক আছে আমিও
বসছি ।
-অনুরাগ, তোমার জোর করে জেগে থাকার দরকার নেই ।আর তুমি ঘুমালে আমার একটুও
খারাপ লাগবেনা । তুমিতো আমার পাশেই আছ ।আমি বসে থাকছি ।অসুবিধা হবেনা ।তুমি
এখানেই শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও ।তোমার ভাল লাগবে ।
অনুরাগ সিমানার কোলে মাথা রেখে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল ।
সিমানা আরা এককাপ কফি পান করে বসে নি¯তব্দ রাতের জ্যোৎস্না ভরা আকাশ আর
ঢেউয়ের গর্জন শুনে শুনে নিজেকে এসবের মাঝে হারিয়ে ফেলল ।সিমানার একটু
হাঁটতে ইচ্ছা করল ।কিšতু অনুরাগ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে বলে উঠতে
পারলনা ।
হঠাৎ সিমানার কেমন জানি অস্বস্থি লাগতে শুরু করেছে ।মাথাটা ঘুরছে,বমি বমি
লাগছে, শরীর কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে জ্বর আসছে ।সিমানা বুঝতে পারল এত বেশী কফি
পান করা ঠিক হয়নি ।
সঠিক পরিচর্যা আর নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকলে এইচ.আই.ভি ভাইরাস
নিয়েও অনেক দিন সুস্থ থাকা যায় ।সিমানা এ সবই জানে এবং অনুরাগের দেখাশুনার
কারনে দু বছর ধরে এসব নিয়মিত মেনেও আসছে ।যে অবস্থায় সিমানা লন্ডন থেকে
ফিরে এসেছিল ,অনুরাগ তার জীবনে না আসলে আরো অনেক আগেই তাকে দুনিয়া থেকে
বিদায় নিতে হত ।
সিমানার সেই দু:সহ দিনগুলির কথা একে একে সব মনে পরতে থাকল ।সিমানার শরীরে
এইচ আই ভি ধরা পরার পর লন্ডনের বন্ধু মহলের সবাই তাকে ত্যাগ করেছিল ।আর তার
বাবা অসুস্থ্য মেয়ের পাশে থেকে মেয়েকে ভরসা দেয়ার বদলে রাশি রাশি টাকা
দিয়েই তার দায়িত্ব পালন করছিলেন । যাদের খাতিরে সিমানা অনুরাগকে অবজ্ঞা করে
বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল তারাই তাকে দু:সময়ে ছেড়ে চলে গেছে ।যখন মৃত্যু খুব
কাছাকাছি চলেএলো ,দূরদেশে বসবাস সিমানার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল ।উপায়াšতর না
পেয়ে সিমানা দেশে ফিরে আসল ।
সিমানা ছিল ব্রোকেন ফ্যামিলির সšতান ।সতের বছর বয়স পর্যšত সে মায়ের কাছে
ছিল ।তারপর লন্ডনে প্রবাসী পিতা আইনি লড়াই লড়ে মেয়েকে জয় করে নিজের কাছে
নিয়ে গিয়েছিলেন ।যতদিন মায়ের কাছে ছিল সিমানার জীবনটা বেশ গুছানোই ছিল
।তারপর অনেকটা না বুঝেই বাবার প্র¯তাবে রাজি হয়ে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিল
।লন্ডনের বিলাসী জীবন-যাত্রা সম্পর্কে পিতার আহবানকে সিমানা অবজ্ঞা করতে
পারেনি ।উন্নত জীবনের হাতছানি সিমানাকে অনেকটা লোভী আর বিবেকহীন করে
তুলেছিল ।মায়ের আদর আর শাসন তখন তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতেছিল । মায়ের
স্নেহের বাঁধন ছিন্ন করে দায়িত্বহীন পিতার আশ্রয়ে গিয়েই সিমানা
সম্পূর্ণভাবে মিশে গেল এক ছন্নছাড়া পরিবেশে ।যেখানে ছিলনা কোন শাসন,ছিলনা
বাঁধন,হাত বাড়ালেই কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল উড়ানোর জন্য ।এভাবেই সিমানা অধ:পতনের
দুনিয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল ।সিমানা চলে যাবার পর তারই চিšতায় চিšতায়
অসুখ-বিসুখে ভুগে কিছুদিনের মধ্যেই মা মারা গেলেন ।
সিমানার শারিরীক অবস্থা যখন চরম সীমায় পৌঁছল,যখন বেঁচে থাকার সবটুকু আশাই
ব্যার্থ হতে চলল,যখন নিজের শরীরের ভার আর নিজে বহন করতে পারছিলনা,একে একে
সবাই দূরে চলে যাচ্ছিল,তখন মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার জন্যই নিজের
মাতৃভ’মিতে ফিরে এল ।এসেছে ঠিকই,কিন্তু এখানে সীমানার এখন কে আছে?“মা নেই
তো অন্য কেউই নেই” ।তার উপর সীমানা মাকে ছেড়ে চলে যাবার কারনে অন্যান্য
কাছের মানুষরাও তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ।আর এই কঠিন অসুখ নিয়ে যখন
ফিরে এল ,সবাই তো ঘৃনায় ,ভয়ে ,লজ্জায় আতংকে সীমানার খোঁজ নেয়াই বন্ধ করে
দিল ।সিমানা বুঝতে পারল ,এদেশের মানুষ এখনো এইডস নিয়ে খোলামেলা কথা
বলেনা,কেউ এই ভইরাসে আক্রাšত হয়েছে তো বিরাট অন্যায় আর জঘন্য কাজ করে
ফেলেছে ।সমাজে এরা অপরাধীর মত জীবন-যাপন করে ।কেউ কাছে আসেনা ,কথাও বলেনা
।ঘৃনার চোখে তাকায় ।সিমানার প্রতি সবার এমন অবজ্ঞা প্রথম প্রথম সিমানাকে
খুব কষ্ট দিত ।তারপর ধীরে ধীরে বা¯তবতাকে মানিয়ে নিল ।
সীমানাও কারো কাছে যায়নি ।এমনি কিছুদিন যাবার পর হঠাৎই একদিন অনুরাগের সাথে
দেখা ।সীমানাকে দেখা মাত্রই অনুরাগের মনে হয়েছিল যে সীমানা আর আগের মত নেই
।সেই জৌলুসতা,সেই চঞ্চলতা সব কিছু কেমন জানি অস্পষ্ট মনে হতে লাগল ।সীমানাও
নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করল ।এমনকি কোথায় থাকছে,কি করছে সেসব ও
অনুরাগরে কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে ।অনুরাগ বুঝতে পেরেছিল যে সীমানার
সময়টা ভাল যাচ্ছেনা ।সিমানা নিশ্চয়ই কোন কঠিন অসুখে ভুগছে ।অত:পর
নাছোড়বান্দা অনুরাগ কৌশলে সীমানার সকল ইতিহাস জানতে সমর্থ হল এবং সিমানাকে
স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রƒতি নিয়ে এ কাজে নিজেকে পুরোপুরি
সমর্পন করে দিল ।
সিমানা যখন বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল অনুরাগ তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল ।আজ
অনুরাগ একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাক্তার ।সিমানাকে অনেকদিন ক্লিনিকে থাকতে হল ্
।অনুরাগের তত্ত্বাবধানে সীমানা ধীরে ধীরে অনেকটাই সু¯্য’ হয়ে উঠল ।যা
সীমানা আগে ভাবতেও পারেনি ।তারপর অনুরাগের বাড়িতেই সিমানার গšতব্য হল ।
যখন সিমানাকে অনুরাগ তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইল সিমানা সমাজের দোহাই দিয়ে
সেই বাড়িতে যেতে রাজি হয়নি ।অনুরাগকে বলেছিল আমার জন্য তুমি সমাজে ছোট হবে
।তুমি আমাকে তোমার বড়িতে নিয়ে যেওনা ।আমি বরং একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি
।ইচ্ছে করলে একটা বাড়িও কিনে ফেলতে পারি ।এখন আমার তো টাকা পয়সার অভাব নেই
।অভাব শুধু আপনজনের ।
অনুরাগ সে প্র¯তাব নাকোচ করে দিল ।বলল,এসময় তোমার পাশে সারাক্ষণ কারো থাকা
উচিৎ ।তোমার চিকিৎসার জন্যও আমাকেই তোমার পাশে থাকতে হবে । সবকিছু মিলিয়ে
তুমি আমার সাথেই যাবে ।এটাই ফাইনাল ।আর সমাজ আমাকে নিয়ে কি ভাবছে সেটা আম
ভাবছিনা ।অšতত পক্ষে তোমার একজন বন্ধু হিসেবেতো আমি তোমাকে একলা ছেড়ে দিতে
পারিনা । সমাজ কি তোমার দেখভাল করবে?তাহলে সমাজের কথা তুমি শুনবে
কেন?তুমিতো লন্ডনে বড় হয়েছ ।তোমাকে তো এতসব ভাবাভাবি শোভা পায়না ।
সিমানা বলে,আমিতো তোমার কথা ভেবে বলছি ।এটাতো লন্ডন না,বাংলাদেশ ।এখানে
দ’ুজন নারী-পুরুষ চাইলেই একঘরে বসবাস করতে পারেনা ।তারপর তোমার বাবা-মা যদি
বেঁচে থাকতেন তাহলে না হয় থাকা যেত ।
অনুরাগ একথা শুনে সিমানার হাত ধরে বলল,চলো আমার সাথে ।
সিমানা বলল, কোথায় ?
-যেখানে গেলে সমাজের স্বীকৃতি পাওয়া যায় সেখানে ।
-তার মানে?
-মানে হল,আমি তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরে নিয়ে যেতে চাই ।এটা শুধু সমাজের
খাতিরেই নয় ।তুমি জান নিশ্চয়ই ,আমি তোমাকে কতটা ভালবাসতাম ,আর এখনো ভালবাসি
।ঠিক আগের মতই ।তাইতো এতদিনেও একা রয়ে গেছি ।এখন সময় এসেছে ।
সিমানা হাত ছাড়িয়ে বলল, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি?
-কেন,পাগলামির কি দেখলে?আমি কি তোমার যোগ্য হতে পারিনা ?
-অনুরাগ, আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার হুশ হারিয়েছ ।তুমি জান, আমার ভিতরে এইচ
আই ভি ভাইরাস ।যা আমাকে তীলে তীলে শেষ করে দিচ্ছে।আর আমাকে বিয়ে করার মানে
কি তুমি বুঝতে পারছ?
-হ্যাঁ পারছি ।তোমার এইডস হয়েছেতো কি হয়েছে?আমারো হবে?হলে হবে ।তুমি বোকার
মত কথা বলছ সিমানা ।তোমাকে ভালবাসি বলে ,আর তোমাকে সুস্থ্য করার জন্যই আমি
তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি ।এখানে এইড্স কোন বিষয়না ।তুমিকি আমাকে কি এতই বোকা
ভাব?আমি জানিনা এইড্স কিভাবে একজনের শরীর থেকে আর একজনের শরীরে ছড়ায়?এইড্স
এ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে একজন সুস্থ্য মানুষের শরীরে রক্ত
দিলে,ব্যবহৃত সূচ,সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে,অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকিপূর্ণ যৌন মিলন
করলে এইড্স ছড়ায়।এছাড়া একত্রে বসবাস করলে,আক্রান্ত ব্যাক্তিকে ছুঁইলে,একই
খাবার খেলে,একই বিছানায় ঘুমালেও এইড্স ছড়ায়না।
আত্রান্ত ব্যাক্তির কাপড় চোপড় থেকেও ছড়ায়না।আমরা না চাইলে কখনোই তোমার থেকে
আমার শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করতে পারবেনা ।এসব তুমি অবশ্যই জানো ।আর আমার
উপর যদি তোমার ভরসা না থাকে, তুমি আর আমি না হয় আলাদা ঘরে থাকব ।তবুও
তোমাকে আমি একা থাকতে দিতে পারিনা ।
অনুরাগের সেদিনের কথা সিমানা শেষ পর্যšত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল ।কিন্তু
সিমানা কিছুতেই অনুরাগকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।সিমানা জীবনে অনেক ভুল করেছে
।জেনেশুনে অনুরাগের মত একজন সৎ,কর্তব্যপরায়ন নি:স্বার্থ বন্ধুর জীবনটাকে
সিমানা নষ্ট করে দিতে পারলনা ।তাই বিয়ে না করেই শুধুমাত্র অনুরাগের কথা
রাখতে গিয়ে সেই বাড়িতে উঠতে হল সিমানার।একই ঘরে থাকছে, খাচ্ছে, কখনো দুজন
মিলে বেড়াতে যাচ্ছে,নিয়মিত ট্রিটমেন্ট চলছে ।সবকিছু মিলিয়ে ভালই কেটে
যাচ্ছিল ওদের জীবন ।কিন্তু সিমানার যে রোগ তাতে তো আর পুরোপুরি সুস্থ্য
হওয়া আদৌ সম্ভব নয় । ভীতরে অনেক যন্ত্রনা থাকা সত্ত্বেও সিমানা সবসময়
নিজেকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করে ।
সবসময় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা, আর জীবনের উপভোগ্য বিষয় থেকে
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা অনুরাগের অপছন্দ । সিমানার ভিতরের মরনাস্ত্র
জীবানুগুলো প্রতিনিয়ত তাকে একটু একটু করে মেরে ফেলছে ,তা অনুভব করতে পেরেও
নিরবে সহ্য করে গেছে , যাতে অনুরাগ কিছু টের না পায় ।অনুরাগ যে কিছুই বুঝতে
পারতনা তা নয়;সিমানাকে মানসিক ভাবে ফিট রাখার জন্যই অনুরাগ সবসময় সিমানার
শারীরিক উন্নতি হচ্ছে বলে ভাব প্রকাশ করত ।
সিমানার একে একে সব কথা মনে পড়তে লাগল ।অনুরাগ সেভাবেই ঘুমিয়ে পরে রইল
বিছানার উপর। কোথা থেকে আজ অনুরাগের চোখে এত ঘুম এসে ভর করল!এদিকে সিমানা
কি ভীষণ যন্ত্রনায় ছটফট করছে ।সারা দুনিয়াটা নিয়ে যেন মাথাটা ঘুরছে । মাথার
শিরাগুলো মনে হয় এখনই ছিড়ে যাবে । নিজের শরীরের তাপে সিমানা নিজেই দগ্ধ হয়ে
যাচ্ছে ।সিমানা কয়েকবার অনুরাগকে ডাকার চেষ্টা করেও ডাকতে পারছিলনা ।সিমানা
অনুরাগের মাথাটা নিজের কোলের উপর থেকে নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল
।একপা একপা করে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ।কি করবে কোন কিছু ভেবে
পাচ্ছিলনা ।ভীষণ বমি বমি লাগছে ,শরীর কাাঁপছে থর থর করে ।দু/তিন পা এগিয়ে
যেয়েই সিমানা নিচে পরে গেল ।তার পর গড় গড় করে বমি করে নি¯েতজ হয়ে ভেজা
বালুর উপর পড়ে থাকল ।এমনি ভাবে কেটে গেল কতটা সময় তা সীমানা-অনুরাগ কেউই
টের পেলনা।
দুর থেকে ভেসে আসছিল ফজরের আযানের ধ্বনি ।হঠাৎ অনুরাগের ঘুম ভেঙে গেল ।চোখ
মেলে আশে-পাশে সিমানাকে না দেখতে পেরে হঠাৎই মনের ভেতর এক ভীষণ আশংকায় লাফ
দিয়ে উঠে সিমানা বলে চিৎকার করে উঠল । এদিক-ওদিক চেয়ে সামনে এগিয়ে সিামানার
নিথর দেহখানি জমিনে পড়ে থাকতে দেখে অনুরাগের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে
যাচ্ছিল ।দৌঁড়ে গিয়ে সিমানার মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসা
ঢেউয়ের থেকে এক কোশ পানির ঝাপটা দিল সিমানার চোখে-মুখে ।
গভীর ঘুমের মাঝে সিমানা যেন শুনতে পাচ্ছে সমুদ্রের ওপার অনেক দূর থেকে কে
যেন তাকে ডাকছে । সাড়া দেয়ার অনেক চেষ্টা করেও কেন জানি দিতে পারছেনা ।কী
যে ভীষণ কষ্ট! একসময় সিমানা চোখ খুলল,দেখল অনুরাগের দ’ু চোখ ভরা অজস্র
অশ্রƒ অঝোরে বিসর্জিত হয়ে হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিশে যেন সমুদ্রকে আরো
ফুঁসিয়ে তুলল । সমুদ্র কি ভীষন ভাবে ক্ষেপে উঠেছে ।গর্জনের পর গর্জন,মনে হয়
এখনি যেন বিরাট ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে নিয়ে যাবে।ভাসিয়ে নিয়ে যাবে
সিমানাকে,ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অনুরাগকে ।সিমানা ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল
।অনেক কিছু বলতে চেয়েও মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছেনা ।সিমানার ভয়ার্ত
চেহারা দেখে অনুরাগ ঘাবড়ে গেল ।অনুরাগ সিমানাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করল
।বলল, চলো তোমাকে এখনি হাসপাতালে যেতে হবে ।বারবার না করেছি ।আমার কথা তো
শোননি । এখন দেখ ,কি হল ।আমাকে ডাকনি কেন?তোমার শরীর এত খারাপ লাগছিল এটা
আমাকে জানালে কি হত? এখন ওঠো,আমাকে ধরে ওঠার চেষ্টা করো ।
এদিকে সিমানা অনুরাগকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল,অনুরাগ এখন তো আমরা যেতে
পারবনা । দেখছনা সারা আকাশট কেমন কালো মেঘে ঢেকে গেছে,সমুদ্র কিভাবে ক্ষেপে
উঠেছে ,কী ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে!এখনি শুরু হবে ঝড়ের তান্ডবতা।সবকিছু ভাসিয়ে
নিয়ে যাবে ।আমরা ওদিকে আর যেতে পারবনা ।ঝড়টা ওদিক থেকেই আসছে । আমরা এখানেই
বসে থাকব ।সমুদ্র আমাদেরকে রক্ষা করবে ।কারণ আমরা সমুদ্রকে ভালবাসি ।ও
আমাদের কোন ক্ষতি করবেনা ।
অনুরাগ বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে সিমানার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলছ এসব?
কোথায় ঝড়? সবকিছুতো স্বাভাবিকই আছে ।অনুরাগ বুঝতে পারল সিমানার জ্বরের
মাত্রাটা খুব বেশি হওয়ায় এরকম আবোল তাবোল বকছে ।এখন অনুরাগ নিজেই সিমানাকে
জোর করে উঠানোর চেষ্টা করছে ।
ওকে এখুনি হাসপাতাল নিতে হবে ।তারপর একটু সুস্থ্য হলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে
রওয়ানা দিতে হবে । আর দেরী করা ঠিক হবেনা ।
অনুরাগ যেই সিমানাকে উঠাতে চেষ্টা করছিল ,অমনি সিমানা গড় গড় করে একগাদা বমি
ঢেলে দিয়ে একেবারে অনুরাগের সারা শরীর মেখে দিল ।অনুরাগ সিমানাকে নিয়ে আবার
বসে পড়ল বালুর উপর ।
সিমানা অনুরাগের হাতদুটি নিজের দ’ুহাতের মধ্যে নিয়ে শক্ত করে ধরে রইল,আর
সারা শরীর ভীষণ কাঁপতে লাগল ।যে শরীর একটু আগেও জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল ,তা এখন
বরফের মত ক্রমেই শীতল হয়ে আসছে । সিমানার এরূপ ভাবগতি দেখে অনুরাগ বুঝতে
পারল সিমনার যাবার সময় হয়ে এসেছে । সিমানার ঠোঁট দুটি কাঁপছে ।অনুরাগের
দিকে চেয়ে কিছু একটা বলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে ।কিন্তু বলার শক্তি যেন
পাচ্ছেনা ।
অনুরাগ বলল,সিমানা তুমি শাšত হও । তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?কিচ্ছু হবেনা তোমার
।আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতেই দেবনা ।
অনেক কষ্টে সিমানার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে ।সিমানা বলল,অনুরাগ আমাকে আর
টানা হেচ্রা করে লাভ নেই । পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় এসে গেছে।তুমি অনেক
করেছ, আর..নয়.।তুমি বরং আমাকে একটু ধরে রাখো,একটু আদর করে দাও।
সিমানাকে অনুরাগ চুপ করানোর চেষ্টা করল । কিন্তু সে কিছুতেই থামছেনা ।সে
আবার বলল,অনুরাগ,আমাকে থামতে বলনা ।বলতে দাও প্লিজ।হয়তো আর সময়ই পাবনা
।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।আমি এখানে এভাবেই তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে চাই
।এই সমুদ্রের পাড়ে,খোলা আকাশের নিচে ,তোমার কোলে আমি মাথা রেখে চিরদিনের মত
হারিয়ে যাব । আমার এ সুখের মরন আমাকে মরতে দাও ।
অনুরাগ বলল, কেন তুমি এখনি মরনের কথা ভাবছ? তোমাকে এখুনি ঢাকা নিয়ে যাব ।
তোমার চিকিৎসা হবে ,আবারো তুমি সুস্থ্য হয়ে উঠবে ।
অনুরাগ,আমাকে নিয়ে তোমার আর ভাবতে হবেনা ।আমি তো চলেই যাব।তারপর তুমি একটা
লক্ষী মেয়ে দেখে বিয়ে করে সংসারী হবে ।তোমার এত সুন্দর ঘর ;সেই ঘরের ঘরণী
থাকবেনা তা কি করে হয় ?তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভাল বৌ পাবে ।ভাল মানুষের সাথে
সবসময় ভালই হয় ।আর আমার মত অভাগির কপালে এমনি দু:খ হবে এটাই স্বাভাবিক ।ঘরে
আসা লক্ষ্মীকে আমি নিজের হাতে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম ।আমার মাকে কষ্ট
দিয়েছি,তোমার সাথে প্রতারনা করেছি ।মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ পাইনি
,এমনি দুর্ভাগা আমি ।মা কত আশা করেছিলেন ,আমাকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে
নিশ্চিšেত বাকিটা জীবনটা পার করবেন ।মায়ের জীবনের সকল সুখ-আনন্দ আমার জন্য
বিসর্জন দিয়েছিলেন ।আর আমি ?মরে গিয়েও আমার এই লজ্জা কাউকে দেখানোর মত নয়
।একটি দিক পাবার জন্য আমি সবদিক হারিয়েছিলাম ।কেন আমি তোমাদেরকে ছেড়ে
গিয়েছিলাম?কেন আমাকে জোর করে আটকে রাখলেনা অনুরাগ?কেন রাখলেনা ?তখন যদি
আমাকে আটকে রাখতে তাহলে আজ আমার এই পরিনতি হতনা ।
সবকিছু হারিয়ে এখন আমার আবার বেঁচে থাকার স্বাধ হচ্ছে ।ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে
করছে । আমি মরতে চাইনা অনুরাগ ।আমি তোমাকে নিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু
করতে চাই ।আমাকে বাঁচাও অনুরাগ,আমাকে বাঁচাও ।আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ।আমি
বাঁচতে চাই ।আমি একটু তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই ।দাওনা একটু ঘুমাতে
আমাকে।
চারিদিকের নিথর নি¯তব্দতা ধীরে ধীরে মৃদু কোলাহলে পরিণত হচ্ছে, ভরা
জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো ম্লান হয়ে গেছে । পূর্ব আকাশে আবার লাল সূর্য জেগে
উঠেছে ধীরে ধীরে ।ভোরের স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে সমুদ্র সৈকতে কিছু কিছু মানুষ
এসে পায়চারি করা শুরু করেছে ।সবকিছু নির্মল,শুভ্রতা ,সজীবতা আর শুদ্ধতার
চাদরে প্রকৃতি যেন আজ সেজেছে নতুন রূপে ।হালকা মৃদু কোলাহল অনুরাগের
চারদিকে গুন গুন করে ধ্বনিত হচ্ছে ।সেদিকে অনুরাগের কোন খেয়াল নেই
।অনুরাগের দৃষ্টি পরে আছে সিমানার দুটি চোখের পাতার উপর ।
মাথাটা একটু নিচু করে সেই ফজরের আযানের পর থেকে এভাবেই তাকিয়ে আছে ।কখন
সিমানা জেগে উঠবে,কখন দু’চোখ মেলে অনুরাগকে দেখে বলবে ,চলো আমরা ঘরে ফিরে
যাই ।অনেকতো হল সমুদ্র দেখা। এবার ঘরে চল। আমার সমুদ্র দেখার স্বাধ ছিল ,
দেখা ও হল ।এখন আর কিছু বাকি নেই।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|