[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক প্রেমের গল্প

শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া

  

 

- শাশ্বত স্বপন -

 

                                                       

 

পর্বঃ ৭

শ্রীনগর ডিগ্রী কলেজের ছাত্র প্রদীপ। পড়ালেখাও করে, ব্যবসাও করে। রবিন, কবীর--ওর খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। ডালু, ফিরোজ অবশ্য ততটা ঘনিষ্ট নয়। কথা না বাড়িয়ে ওরা রিক্সায় চড়ে ঘোড়াদৌড় বাজারে চলে আসে। এখানে এসে তারা বিপদে পড়ে। পদ্মার কড়াল গ্রাসে লৌহজং থানার উল্লেখযোগ্য দক্ষিণাংশ বিলীন হয়ে গেছে। দিঘলী, সংগ্রামবীর, ভোজগাঁও, গাঁওদিয়ার অধিকাংশ স্থান পদ্মার পানির তলে। শুভ লৌহজং এর পদ্মার ভাঙ্গন শুনেছে। কিন্তু এমন ভয়াবহ--তা সে কল্পনাও করেনি। যদি রিনা আপার শ্বশুর বাড়ি বিলীন হয়ে থাকে, তবে তো বিরাট সমস্যা। গাওদিয়া পর্যন্ত রিক্সা যায় না। ঘোড়াদৌড় থেকে মালির অংক পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর দেড় মাইল হাঁটতে হবে, স্থানে স্থানে ভাঙ্গা রাস্তা । শুভ একজনের কাছে গাওদিয়া যাবার পথ সম্পর্কে জেনে রিক্সায় উঠল। রাস্তার দু’পাশে উদ্ধাস্তুদের ছাপরা ঘর আর ঘরগুলিতে হাঁস-মুরগির মত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা বসবাস করছে, যেন পোকা মাকড়ের বসতি। ছোট ছোট বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কয়েক ঘরের মহিলারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। হয়তো স্বামীকে নয়তো পাশের মহিলাকে। দক্ষিণ দিক থেকে ঘরের বেড়া, দরজা, টিনের চাল কুলিরা বয়ে আনছে উত্তর দিকে। রাস্তায় যেন, মেলা মিলেছে। ওদের দু’জনার ভয়, যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়। মানুষেরা পদ্মার ভাঙ্গন দেখে , হারানো স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজ নিজ গন্তব্য পথে চলেছে। কিচু মানুষ জটলা পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গন নিয়ে আলোচনা করছে। শুভ, ইন্দ্রানীর কারো সে সব আলোচনা শুনার সামান্য আগ্রহ নেই। শুভ মনে করতে চেষ্টা করছে, সে দিনের কথা, যে দিন সে তার চাচাত বোন রিনার সাথে তার শ্বশুর বাড়ি গাওদিয়া এসেছিল। রাস্তাঘাট গুলি সে মনে করতে পারছে না। জনে জনে জিজ্ঞাসা করে, তারা বেজগাও হাইস্কুলের পাশের ছোট একটা রাস্তা ধারে এগিয়ে চলল। জনে জনে জিজ্ঞাসা করার একটা সমস্যা হচ্ছে, সবাই ইন্দ্রানীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পারেতো কিছুটা এগিয়ে দেয়। শুভ ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসে। রাস্তার এক দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে তারা হেঁটে হেঁটে খেতে লাগল। ভয় তাদের এখন অনেক কমে গেছে। এই এলাকায় সন্ধ্যা হওয়ার পরই অন্ধকার নেমে আসে। ইন্দ্রানী চারদিকে তাকাচ্ছে, রাস্তায় জন-মানব কেউ নেই। আশে পাশের বাড়ির মানুষজনও ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না। সে ভয় পেল।

--আর কতদূর?

রাস্তাটি ফসলের মাঠের বুক ছেদ করে সম্মুখে চলমান। দু’পাশে ফসল আর ফসল। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা অনবরত ডাকছে। ইন্দ্রানী শুভর হাত ধরে আছে। শুভ পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চাপাল।

--দোকান থেকে তুমি সিগারেটও কিনেছ! সিগারেট খাবে না।

--তুমি যখন কষ্ট দিয়েছিলে। ঠিকমত চিঠি দিতে না, দেখা করতে না, তখন এই সিগারেট ধরেছি। নেশা হয়ে গেছে। এখন অন্ধকার ভূত, পেত্নী ধরতে পারে। আগুন থাকলে কেউ আসতে সাহস পায় না।

-- ইস, কি দুর্গন্ধ!

-- কাল থেকে খাব না, ঠিক আছে?

-- এই গন্ধ খাও কি করে?

-- কোথায় গন্ধ? তোমার দেওয়া বেদনাগুলি গিলছি, হৃদয়কে জানিয়ে দিচ্ছি।

-- কতদিন জানাবে?

-- যতদিন তুমি সুখ না দিচ্ছ।

--খবরদার, আমার নাকে ধূয়া দেবে না।

-- ধূয়া নয়, হৃদয় তোমাকে কি যেন বলতে চায়।

--ফাজলামি কর না বলছি--

শুভ জোড় করে ইন্দ্রানীর ঠোঁটে চুমা বসিযে দেয়। ইন্দ্রানী ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দেয়। শুভ অন্ধকারে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও অন্ধকার তবুও ইন্দ্রানীর ফর্সা দেহের বিচ্ছুরিত আলো যেন ওকে দেবী-মূর্তি করেছে। শুভ ওর আরো কাছে এল-

--আমার দেবীকে দেখছি

--এই-

--আমাকে একটা চুমো দাও না?

--তাড়াতাড়ি চল-

--আগে দাও

-- চোখ বুজে ফেল

ইন্দ্রানী ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় একটা চুমা বসিয়ে দিল এবং ব্যাপারটাকে ঘুরিয়ে ফেলার জন্য সিগারেট নিজের হাতে নিয়ে বলল, দেখ কেমন নিঃশেষ হচ্ছে।

--ব্যর্থ প্রেমিকের জীবনের মত, তাই না? তোমাকে ছাড়া আমার জীবনও-

-- তোমাকে ছাড়া আমি ধুকে ধুকে মরে যেতাম।

-- আরে দূর, মেয়েদের জোর করে, যে পাত্রে রাখা হয়, সে পাত্রের আকারই ধারন করে--ঠিক পানির মত। বীথি আপা তো কামাল ভাইকে ছাড়া মরেই যাবে বলছিল। বিয়ে হওয়ার পর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে।

--আমি তোমাকে না পেলে ভুলে যেতাম--কখনো না। মা-বাবা, ভাই-বোন, ধর্ম-কর্ম সব বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার পথে পালিয়ে এসেছি। কি রকম ভালবাসা থাকলে পালিয়ে আসা যায়, বল। কামাল ভাই-বীথি আপা পালাতে পারল না। আসলে সত্যিকারের ভালোবাসা জন্মায়নি--অবিশ্বাস ছিল, নয়তো ভয় ছিল।

-- তাই হয়তো। তুমি আমার কথায় মাইন্ড করেছে। আমি এমনি বলেছি। তোমার-আমার ভালোবাসার ব্যাপার আলাদা। যে ভালোবাসা তোমাকে-আমাকে ঘর ছাড়া করে ভালোবাসার দুর্গম পথে টেনে এনেছে; সে ভালোবাসার পরিনাম যত খারাপই হোক--তা মহৎ। জনে জনে এখন হয়তো ঘৃনা উঠবে কিন্তু ভালোবাসার বৃত্তে জীবন্ত থাকবে যুগ যুগ ধারে। ভালোবাসার স্রষ্টা যেন, সহায় হোন আমাদের জীবনে।

--তুমি স্রষ্টা বিশ্বাস কর?

--ইন্দ্রানী, পৃথিবীর উপরে এই যে ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, ব্রীজ, হাট-বাজার, শহর-বন্দর তথা সভ্যতা সবই মানুষের সৃষ্টি--বাহ্যত যা দেখা যায়। প্রথম মানুষ কে সৃষ্টি করল? এমনি এমনি কি হয়ে গেল? পৃথিবীর কোন কর্মকান্ড এমনি এমনি হয়েছে বা হচ্ছে? কোন কর্মকান্ডই না। মানুষের হৃদপিন্ডের গতিশক্তি কোথা হতে আসছে। এই যে সৌরমন্ডল, এসব কি এমনি এমনি হয়ে গেল। অনেকে বলবে প্রাকৃতিক কারণ, প্রকৃতি সব কিছু করছে, মানলাম, প্রকৃতিকে চালাচ্ছে কে? শেষ উত্তর কি হবে--জানি না। তবে, আমি যেটা বুঝি, সর্বশক্তিমান বলতে কিছু একটা আছে। যদি মানুষ ভাবে, স্রষ্টা বলতে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক, ধর্ম-কর্ম সব ভূয়া, মিথ্যা--তাহলে মানুষের কি অবস্থা হবে! আমার তো মনে হয়, সব মানুষই পাপ করবে, আরো ভোগবাদী হয়ে উঠবে। স্রষ্টা বিশ্বাসহীন একজন ব্যক্তি মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে কি ভাববে? ভাববে, জীবন কি, কেন জীবন, কোথায় যাচ্ছি ! এরপর, জীবনটা মাটি হয়ে যাবে, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই...? তার মৃত্যুটা বেশ কষ্টে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সে মানসিক কষ্টে মারা যাবে।

--থাম, মৃত্যুর কথা শুনলে ভয় করে। রাতের বেলা এসব গল্প কেউ করে? ভয় করে না, শুনলে?

-- ঠিকই বলেছ।

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ