[প্রথমপাতা]
|
ত্রি-রূপে মাতৃ হৃদয়
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
আমার যখন আট বছর বয়স ,তখন মা আমার ছোট ভাইটিকে জন্ম দিতে গিয়ে দুনিয়া থেকে
বিদায় নিলেন। আমরা চার বোন ছিলাম। বাবার অনেক শখ ছিল যেন আমাদের একটি ভাই
হয়। বাবাকে তার শখের পুত্রটি উপহার দিয়েই মা আমার চলে গেলেন চিরতরে। বাবা
পেলেন পুত্র ,আর আমরা হলাম মা-হারা ।
আমার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। আমি আর আমার ছোট বোনটা মিলে
ছোট্ট ভাইকে দেখাশুনা করতাম। ভাইটি শুধু দিনরাত কাঁদতেই থাকত। তাকে সামলাতে
না পেরে সাথে সাথে আমরা দুই বোনও কাঁদতাম। ভাইটি যে কাকে খুঁজত সেটা কি আর
আমরা বুঝতে পারতাম ?
এদিকে আমার লেখাপড়া যে একেবারে বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল। থমকে যাচ্ছিল
আমাদের দু’বোনের বড় হওয়া।
একদিন আমার মামা এলেন আমাদের বাড়ি । বাবাকে বললেন, মিঞাভাই ,আপনার এই দুধের
শিশুকে লালন পালন করতে যেয়ে এই দুই শিশুর জীবনটাও যে নষ্ট হচ্ছে সেটাকি
আপনি দেখছেন ? বাবা কোন কথা বলতে পারলেন না। যেন এটা কোন কথাই হল না।
শুনেছি আমার মা শারীরিক ভাবে অনেক অসুস্থ্য থাকার পরেও বাবার পুত্রের শখ
মেটাতে যেয়েই ভাইটিকে জন্ম দেয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তখন আমার মামা বাড়ির
সকলে বাবার উপর রেগেছিলেন। আমার মা এর ঐ একজনই ভাই ছিল ;আর মা ছিলেন তার
একমাত্র বোন। মামা মাকে অনেক ভালবাসতেন। নানা –নানী মারা যাবার পর এই মামাই
মাকে বড় করেছেন।
আমার ছোট্ট ভাইটির জন্মের আগে আমার মামীতো একদিন বলেই ফেললেন ,এ যাত্রায় আর
মা আমার টিকবে না। আর টিকেওনি।
সংসারের শ্রীহীন অবস্থা দেখে মামা এক রকম জোর করেই বাবার কাছ থেকে আমাকে
তার সাথে করে নিয়ে গেলেন। মামার দুই মেয়ে,কাকলী আর কোয়েলী। ওদের সাথে আমিও
মামীর øেহ মমতায় এক সাথে বড় হতে লাগলাম। মামী যে আমার মা ছিলেন না সে কথাটি
আমার আর কোনদিন মনে হয়নি। মা ছাড়া দুনিয়াতে মায়ের মত যে মমতা আর কারো থাকতে
পারে,সেটা মামীকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না।
আমি চলে আসার পর বাবা ভাইটিকে নিয়ে যেন মহা সমুদ্রে পড়লেন। এতটুকু শিশুকে
নিয়ে তিনি এখন কোথায় যাবেন, কি করবেন,কার কাছে রাখবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন
না। আদরের ভাইটি আমার দিনে দিনে অনাদর,অবহেলা আর অযতেœ ক্রমেই দুর্বল হয়ে
পড়ল। আমারো মাঝে মাঝে ভাইটির জন্য খুব মন কেমন করত।
মা ছাড়া এতটুকু শিশু কিভাবে বেঁচে থাকবে সেই ভাবনায় আমারো ভাইটির কথা মনে
পড়ে চোখে পানি চলে আসত। কত রাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি ছোট্ট ভাইটির জন্য ।
একদিন শুনতে পেলাম ,বাবা ঘরে একজন নতুন মা নিয়ে এসেছেন। মামার সাথে আমিও
নতুন মাকে দেখতে গেলাম। কিন্তু তার মধ্যে কেন জানি আমি মায়ের কিছইু দেখতে
পেলাম না। যেমনটা আমার মামীর মধ্যেও দেখতে পাই।
ভাইটিকে দেখাশুনার জন্যই এই নতুন মায়ের আগমন হয়েছিল আমার বাবার ঘরে। আর তার
পরিচর্যা আর অপপরিচর্যায়ই ,অপুষ্টি আর অযতেœ থেকে থেকে ভাইটি আমার ১১মাস
বয়সেই বাবাকে,আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেল আপন মায়ের কাছে।
“মা”শব্দটির আগে “সৎ” কথাটি যুক্ত হলে সেই মা যে কেন আর সৎ থাকে না সেটি
আমি আজও বুঝতে পারি না। তবে সব সৎ মায়েরাই অসৎ হয় সেটা আমি বলছি না। কিন্তু
আমার এই মা’ই কেন যে হলেন !
কিছুদিন পর আমার নতুন মায়ের কোলে আমার আরো একটা বোন আসল। তারপর আর একটা ভাই
, আর একটা বোন। নতুন মা , নতুন ভাই বোন নিয়ে বাবা আমার এখন বেশ ভালই আছেন।
আমার ছোট বোনটা সেই ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা আর ঘরের কাজে মাকে সাহায্য
করে। বাবা-মায়ের ঘরে থেকেও বোনটি আমার এতিমের মত বড় হচ্ছে।
ছোট বোনটার জন্য আমার কেমন মায়া হয় । মা নেই,বাবা থেকেও যেন নেই ,নিজের ঘরে
পরের মত থাকে,কাজ করে,দিলে খায় না দিলে খায় না। আমার তো তবু মামী আছে,যে
মায়ের আদর দিয়ে আমাকে দুখ কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছে । অনেক ইচ্ছা করে রূপালীকেও
আমার কাছে নিয়ে আসি । কিন্তু মামা আর ওকে আনবে না। কারন আমাকে যখন নিয়ে
আসলেন বাবা অনেক রাগ করেছিলেন মামার উপর।
এসব এখন আমি খুব ভালই বুঝতে পারি। কেননা এখন আমার বুঝার মত সময় হয়েছে। আমি
আর সেই আট বছরের বালিকাটি নই।
আট বছর বয়স থেকে আমি মামা-মামীর কাছে বড় হচ্ছি। কোন একটি দিনের জন্যও আমার
মনে হয়নি আমি বাবা-মায়ের কাছে নেই। মামী আমাকে কাকলী কোয়েলীর মতই øেহ ,আদর
,ভালবাসা আর শাসনে বড় করেছেন। এই মামীটি যেন এক চিরন্তন মায়েরই প্রতিচ্ছবি।
মায়ের মমতার যে কোন সীমা-পরিসীমা নেই,সেটি মামীই প্রমান করলেন। আর আমি তার
সাক্ষী হয়ে রইলাম।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|