[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

অন্য দেশের পতাকার টাট্টু আঁকা মুখ, এ লজ্জা কার!

 

 

মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম

খেলা-ধূলার আসরে বেশীর ভাগ বিভাগে আমরা পিছিয়ে থাকলেও পিছিয়ে নেই দর্শক হিসেবে কোন না কোন টিমকে সমর্থন ও উৎসাহদানে । আমাদের তুলনা আমরাই, সব কিছুইতেই বেশী-বেশী, ছাড়িয়ে যাই সীমা-পরিসীমা । ম্যারাডোনা মেসি রোনাল্ডো নেইমাররা বাংলাদেশকে না চিনলে কী হবে, বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে আমাদের জাতীয় দলের অবস্থান না থাকলে কী হবে, ভীনদেশী দলকে উৎসাহ দানের প্রতিযোগীতায় আমরা আছি সবার উপরে, বাড়ী-গাড়ী অলি-গলি ছেঁয়ে ফেলি ভীন দেশের পতাকায় । দেখা যায় ভীন দেশীয় পতাকা টাঙানোর প্রতিযোগীতায় নিজ দেশের জাতীয় পতাকার অবস্থান নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ভীন দেশী পতাকার ভিড়ে আমাদের পতাকা ঠাঁই হয় না, আবার কোথাও কোথাও ঠাঁই হলেও উচ্চতা ও মর্যাদাগত অবস্থানটা রীতিমত অবমাননাকর । আর বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বাংলাদেশী সমর্থকদের চেহারা ও আচরন রীতিমত ভাবিয়ে তুলছে আমাদের জাতীয়তা ও মর্যাদাবোধ কতটা হাস্যকর ও ঠুনকো পর্যায়ে আছে । আমরা নিজস্বতা ভুলে অন্যদেশ নিয়ে বেশী মাত্রায় উদ্বেলিত । বাংলাদেশের মাঠে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ঐসব রাষ্ট্রের পতাকা এবং পতাকার আদলে মুখে টাট্টু আঁকা বাংলাদেশী নাগরিকদের উপস্থিতিকে কী বলবেন ? উদারচেতা মানুষিকতা নাকী সীমান্তহীন ভালবাসা নাকী জাতীয়তা ও সন্মানবোধের মহা আকাল ।
বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান বা অন্য দলকে সমর্থনের নামে দেখা যায় অতিশয় উন্মাদসম দৃষ্টিকটু বাড়াবাড়ি । এসব নিয়ে কথা তুললে এক শ্রেনীর মানুষ বলেন- খেলার মধ্যে রাজনীতি আনাটা ঠিক নয়, ভালো খেলুড়ে দলকে সমর্থন দেয়াই যায় । আমার বিবেচনায় ক্রীড়ামোদী দর্শক হিসেবে নিজ দেশের পর অন্য যে কোন দেশীয় দলকে দ্বিতীয়/তৃতীয় পছন্দের দল হিসেবে পরিশালীত সমর্থন সূচক হাততালী দোষের কিছু নয়, আর এই ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় দলের টুর্ণামেন্টে টিকে থাকার সমীকরনটা প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত । কিন্তু আমরা যেভাবে অন্য দেশের জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে নাচা-নাচী করি, শরীর ও মুখে ভীনদেশের পতাকার আদলে টাট্টু এঁকে এবং ভীন দেশের জার্সি পড়ে মাঠে হাজির হই, তা কী জাতিকে লজ্জা দেয় না ? আমাদের জাতিগত মর্যাদা ও জাতীয়তাবোধকে প্রশ্নবিদ্য করে না ! ভেবে বলুনতো- এক) আমরা কী পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্রের উদাহরন দেখাতে পারবো -যেখানকার জনগন আমাদের মত ভীনদেশের খেলা সমর্থনের নামে ভীন দেশের পতাকায় ছেঁয়ে ফেলে পুরো দেশ । দুই) কোন জাতি-রাষ্ট্র কর্তৃক শোষন নির্যাতন-নিপীড়ন ও উপেক্ষার শিকার হওয়া রাষ্ট্রের জনগন নির্যাতনকারী রাষ্ট্রটির খেলা-ধূলায় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সমর্থন যোগান দেয় এবং সফলতায় গৌরববোধ করেন, এমন জাতির উদাহরন পাওয়া যাবে কী ? তিন) পাকিস্তান কিংবা ভারত কিংবা অন্য যে কোন রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে দেখাতে পারবেন কী- অন্য রাষ্ট্রের পতাকা মুখে এঁকে, ঐ দেশের জার্সি গায়ে দিয়ে এবং পতাকা হাতে নিয়ে নাচা-নাচী করে সমর্থন দিতে ? নিশ্চয় স্বীকার করবেন, এ রকম একটি উদাহরনও খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
তাহলে আমরা যারা ভীন দেশী দলকে সমর্থনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলি খেলার মধ্যে রাজনীতি আনাটা ঠিক নয়, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে রাজনীতি কোথায় নেই ? রাজনীতি সর্বত্রই আছে, খেলার মধ্যেও আছে । যিনি বলেন রাজনীতি আনা ঠিক নয় -স্বজ্ঞানে অজ্ঞানে উনিও কমবেশী রাজনীতি করেন । ক্রিকেটে দল হিসেবে বাংলাদেশের দলটি বর্তমানে ভারত কিংবা পাকিস্তানের চাইতে ভালো খেলুড়ে দলে পরিণত হয়নি, তাই বলে বাংলাদেশ-ভারত বা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে খেলার সময় আমরা ভালো দল হিসেবে ভারত বা পাকিস্তানকে সমর্থন করি ! নিশ্চয়, তা কিন্তু করিনা । কারন আমার দেশ, আমার পতাকা, আমার রক্তার্জিত স্বাধীন রাজনৈতিক ভূখন্ড বাংলাদেশের সন্মান মর্যাদা সকল প্রকার ভালো-খারাপের উর্ধ্বে । আর এই চেতনাবোধই হচ্ছে রাজনীতি । আর এই রাজনৈতিক চেতনা ধারন করে আমরা ভারত পাকিস্তান সহ অন্য যেই কেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মার্তৃভূমি বাংলাদেশকে সমর্থন যোগাই ।
এছাড়া যারা বলেন-ভালো খেলুড়ে দলকে আমি সমর্থন করি, তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য- খেলার সফলতা-ব্যর্থতার উপর ভিত্তি করে প্রতিনিয়ত ভালো খারাপ দলের র্যাংকিং পরিবর্তত হয় । আমরা কী র্যাংকিং এর সাথে সাথে দল পরিবর্তন করি ? তা কিন্তু করি না, তাহলে ভালো খেলুড়ে দলের যুক্তিটা শক্তিশালী যুক্তি নয়, এর মাঝে রাজনীতিও জড়িয়ে আছে । যে লোকটি ভারতীয় বা পাকিস্তানী দলকে সমর্থক করেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই করেন, দুই-একটি বিষয়ে ভারত বা অন্য দুই-একটি বিষয়ে পাকিস্তান সমর্থন করেন, তা নয় । দেখা যাবে, আমরা সেই ভীন দেশীয় দলটিকে বেশী পছন্দ করি যে দেশটির সাথে আমার ধর্ম সংস্কৃতি ও রাজনীতিগত বিশ্বাসের সম্পর্ক খুঁজে পাই ।
যাহোক, প্রশ্ন জাগতে পারে সাউথ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলকে সমর্থন নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্কযুদ্ধের উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয়না । অথচ ভারত-পাকিস্তান সমর্থন নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি রকমের তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি । সাউথ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ডের মত দলগুলি নিয়ে তর্কযুদ্ধ বা পাল্টাপাল্টি আক্রমন না করার কারনটাও রাজনৈতিক । এই রাষ্ট্রগুলি যদি আমাদের সীমান্তর্তী হতো বা এদের মধ্যে আমেরিকার মত আধিপত্যবাদী রাজনীতি থাকতো বা আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে ওদের প্রভাব থাকতো, ঠিকই আমরা পক্ষে-বিপক্ষে মাতম তুলতাম ।
ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- আমাদের পক্ষ থাকতে আমরা কেন ভীনদেশীদের পক্ষে মাতম তুলছি, এতে যে আমাদের জাতীয়তাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে খবরইবা কজনে রাখছি । ন্যাক্কারজনক এই পরগাছা মানুষিকতার চর্চা পরিহার না করলে আমাদের জাতীয়তাবোধ খর্ব হবে এবং বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিণত হব । তাই ভূ-রাজনৈতিক বলয়ে অন্তর্ভূক্ত ভীনদেশী জাতীয় দলের সমর্থক সেজে অতিশয় বাড়াবাড়ি বন্ধে গন সচেতনতা তৈরী এখন সময়ের দাবী ।
খেলা-ধূলার সফলতা যেহেতু একটি দেশকে বিশ্ব দরবারে অল্প সময়ে ব্যাপক পরিচিতি দান করে এবং দেশটি সন্মান-মর্যাদায় উচ্চতর আসনে সমাশীন করে । পাশা পাশি ঐ দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জীবন ধারার প্রতি বিশ্ববাসীর বাড়তি আকর্ষন ও আগ্রহ তৈরী করে । সেহেতু আমাদের উচিত আমাদের খেলাকে নিয়েই থাকা এবং অন্যদের জার্সি পড়ে জাতীয় পতাকা নিয়ে নাচা-নাচী ও টাট্টু আঁকার লজ্জাস্কর অধ্যায়কে পরিহার করে আত্ম-মর্যাদা বোধ সম্পন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত হওয়া । হতে পারে আমার দেশ- এই মুহূর্তে দূর্বল দেশ, তবুও স্বপ্ন দেখি-এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ।


----o----
পাদটীকাঃ বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের পাকিস্তান-শ্রীলংকা ম্যাচে পাকিস্তানী দলের সমর্থণ ও উৎসাহদানে পাকিস্তানী দলের জার্সি পড়ে, মুখে পাকিস্তানী পতাকার টাট্টু এঁকে এবং পতাকা হাতে নিয়ে সরব উপস্থিতি এবং পাকিস্তানের পরাজয়ে বাংলাদেশী তরুণীর কান্না দেখে খটকা লাগে, বিস্ময়াভূত হই, এই দৃশ্য দেখার কথা ছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে । এই বিসদৃশ দৃশ্য দেখে ভেবেছিলাম ভারতীয় দলের সমর্থক বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীরা হয়তঃ অনুরূপ কাজই করেন । তাই ভারতীয় দলের সমর্থকদের আমি সমান ভাবে সমালোচনা করেছি । পরবর্তীতে লিখার সাথে সামঞ্জস্য ছবি সংগ্রহে ইন্টারনেটে গুগলে সার্চ করি । কিন্তু ভারতীয় দলের সমর্থক বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের ভারতীয় পতাকা হাতে নিয়ে এবং মুখে টাট্টু এঁকে মাঠে এসেছে এমন ছবি খুঁজে পাইনি, যা প্রশংসনীয় । তাই পাকিস্তানী দলের সমর্থক এবং ভারতীয় দলের সমর্থকদের এক পাল্লায় সমলোচনা জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি ।
এতসব পড়ে ভাববেন না-আমরা ক্ষয়ে যাচ্ছি, আশাবাদী হওয়ার কিছু অবশিষ্ট নেই আমাদের । বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে মুশফিকুর রহিম আফ্রিদির ক্যাচটি মিস্ করায় গ্যালারী জুড়ে নীরব বিষন্নতা নেমে আসে এবং দুজন তরুণী পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে, হয়তঃ ওদের কান্নায় অনেকে কেঁদেছেন । ওদের দেখে আশায় বুক বাঁধি, ওরা বাংলাদেশকে ভালবাসে এবং ধারন করে, ওরাই আমাদের ভবিষ্যত, আগামীর বাংলাদেশ -স্যালুট ওদের ।


প্রবাসী, জাপান ।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ