লুৎফর রহমান রিটন
বন্ধু রাসেল, ১৯৯৬ সালে, ১৮ অক্টোবর
তোমার জন্মদিনকে সামনে রেখে একটি চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে। সেই চিঠিটি
ছাপা হয়েছিলো ছোটদের কাগজ নামের একটি পত্রিকায়। আমার সম্পাদনায়
পত্রিকাটি বেরুতো। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছিলো
পত্রিকাটি। বিশ্ব শিশু দিবস আর শিশু অধিকার সপ্তাহে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর
সংখ্যাটি আমরা প্রকাশ করেছিলাম তোমাকে বিষয় করে। টকটকে লাল রঙের
প্রচ্ছদে মিষ্টি একটা ছবি ছিলো তোমার। প্রচ্ছদ কাহিনির শিরোনাম ছিলো
“রাসেল হত্যার বিচার চাই।” দেশের বিখ্যাত মানুষেরা লিখেছিলেন তোমাকে
নিয়ে, সেই সংখ্যায়। তোমার হাসুআপাসহ সেই সংখ্যায় লিখেছিলেন সুফিয়া
কামাল, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত,
আনিসুজ্জামান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সেলিনা হোসেন, মমতাজউদদীন আহমদ,
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, তোয়াব খান, আবেদ খান, শামসুজ্জামান খান, বেলাল
চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, রাহাত খান, হাশেম খান, রশীদ হায়দার, ফজল-এ-খোদা,
কাইজার চৌধুরী, শাহাবুদ্দীন নাগরী, আমীরুল ইসলাম, আহমাদ মাযহার, গোলাম
কিবরিয়া এবং তপন বাগচী। আমার লেখাটি ছিলো চিঠির ফরম্যাটে।
ছোটদের কাগজের প্রচ্ছদে শিল্পী ধ্রুব এষের আঁকা ঝলমলে কোনো শিল্পকর্মের
বদলে হঠাৎ তুমি কেনো? তোমার ফটোগ্রাফ কেনো? সম্পাদকীয়তে সেটা ব্যাখ্যা
করে বোঝাতে হয়েছিলো। বলেছিলাম—“কোনো কোনো অভিভাবক অভিযোগ করেন, আমি নাকি
বেশি বেশি রাজনীতি শেখাচ্ছি ছোটদের। আমি তখন তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করি—আমি
যেটা করছি সেটা মোটেও অন্যায় কিছু নয়। স্বাধীনতার পক্ষে কথা বললে,
জাতির জনক বংগবন্ধুর কথা বললে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিপক্ষে কথা বললে,
যদি রাজনীতি শেখানো হয় তাহলে আমি বলবো যে আমি কোনো অপরাধ করছি না। এই
যেমন চলতি সংখ্যায় রাসেল হত্যার বিচার চেয়েছি আমরা। রাসেল হত্যা মানে
শিশু হত্যা। ছোটদের কাগজ শিশু হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না এটা কি
ভাবা যায়? রাসেলের বাবা শেখ মুজিব রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাসেল তো
রাজনীতি করতো না! এখন, যে রাজনীতি রাসেলের মতো নিষ্পাপ শিশুর
হত্যাকাণ্ডকে অনুমোদন করে সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলাটাও যদি রাজনীতি
হয় তাহলে তো বলতেই হয়—এই রাজনীতি করা খুব প্রয়োজন। মানবিক কারণেই
প্রয়োজন।’’
রাসেল,
ভয়ানক প্রতিকুল একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তোমাকে, তোমার বাবাকে, মাকে, তোমার দুই ভাইয়া
আর দুই ভাবীকেসহ এতোজন মানুষকে হত্যা করার পর আমাদের সংবিধানে পৃথিবীর
ইতিহাসের সবচে অদ্ভুত-বর্বর-নিষ্ঠুর-জঘন্য একটা আইন সংযোজন করিয়ে
নিয়েছিলো খুনীরা। সংবিধানে লেখা হয়েছিলো—এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা
যাবে না! ভাবতে পারো রাসেল! কলংকজনক এই আইনটি ছিলো আমাদের সংবিধানের
লজ্জা। কুখ্যাত এই আইনটির নাম ছিলো—ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। কোনো সুস্থ ও
বিবেকবান সভ্য মানুষ এই আইন মানতে পারে না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমরা
বাংলাদেশের মানুষেরা এই আইনটি মেনে নিয়েই বেঁচে ছিলাম দীর্ঘদিন,অবলীলায়!
তোমার হাসু আপা ১৯৯৬ সালে ইলেকশনে জয়ী হলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন।
তারপর সংসদে এই অমানবিক আইনটি বাতিল করা হলো একুশ বছর পর।
পঁচাত্তুরে মোশতাক সরকার ঘাতকদের নিরাপদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
কিছুদিন পর মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে সেইসব
খুনীদের চাকরী দিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে। সে
আরেক ঘৃণ্য ইতিহাস। জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে একাত্তরের
ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এমনকি একজন রাজাকারকে
দেশের প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন! জিয়ার আমলেই একজন রাজাকার হয়েছিলো
সংসদে ডেপুটি স্পীকার!
১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ-পাঁচটি বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও খুনীদের
শাস্তি দিতে পারেননি তোমার হাসু আপা। পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন
না করেই তোমার হাসু আপা ২০০১ সালের ইলেকশনে পরাজিত হলেন। বিএনপি –জামাত
জোট সরকার ক্ষমতায় এলো। দেশের ওপর নেমে এলো আরেকটি ঘন-ঘোর অন্ধকার সময়।
একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনীদের সংগে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো
বিএনপি জামাত জোট সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির প্রতিটি মানুষের
ওপর নেমে এলো নির্মম নির্যাতন, নিষ্ঠুর নিপীড়ন। দেশব্যাপী শুরু হলো
হত্যা ও লুন্ঠন। পূর্ণিমাসহ বেশ কজন সংখ্যালঘু মেয়েকে ধর্ষণও করা হলো
প্রায় প্রকাশ্যে। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু এইসবের
কোনো বিচার হলো না। রাজনৈতিক প্রতিরোধ না গড়ে তোমার হাসু আপার কিছু
‘দৃশ্যত শক্তিধর কার্যত অকেজো বাহাদুর পোষ্য’ দেশ থেকে পালিয়ে গেলো
চোরের মতো। তোমার হাসু আপা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এইসব তথাকথিত বীরদের
প্রবল হুংকারে কান পাতা দায় ছিলো। অথচ তোমার হাসু আপার বিপদের দিনে
তারাই পালিয়ে গিয়েছিলো সবার আগে। ২০০১ এর ইলেকশনের পর থেকে দেশটাকে
খুবলে খামচে ক্ষত-বিক্ষত করা হলো পরবর্তী পাঁচটি বছর। ২০০৮ সালের
ইলেকশনে আবারও জয়ী হলেন তোমার হাসু আপা। এবার তিনি আর বোকামি করলেন না
আগের মতো। তোমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হলো। ২০০৯
সালের ১৯ নভেম্বর পাঁচজন খুনীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করলো আদালত। মনে পড়ে
রাসেল, সেদিন সকালে আমি ঢাকাতেই ছিলাম। চ্যানেল আই সেইদিন দুপুর সাড়ে
বারোটায় তাদের প্রতিদিনের নিয়মিত লাইভ অনুষ্ঠান তারকা কথন-এ সাংবাদিক
মুনীরুজ্জামান আর আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। মন খুলে আমরা সেদিন বলতে
পেরেছিলাম—দীর্ঘদিন পর জাতি কলংকমুক্ত হয়েছে। দায়মুক্ত হয়েছে। একজন
দর্শক সরাসরি টেলিফোনে সংশয় প্রকাশ করলেন—জাতির পিতার ঘাতকদের ফাঁসির
আদেশ কি কার্যকর হবে আদৌ? আমি জবাবে বলেছিলাম—হবেই হবে। বাংলার মাটিতে
জাতির জনকের হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর হবেই। অবশেষে ২০১০ সালের ২৮
জানুয়ারি পাঁচজন খুনীর ফাঁসি কার্যকর হলো। আহা দেশজুড়ে মানুষের কী
বিপুল আবেগ আর উচ্ছ্বাস! অচেনা মানুষজনও পরস্পর পরস্পরকে আলিংগন
করছিলেন অশ্রুসজল নয়নে। দেশের মানুষের সেই অশ্রু বেদনার ছিলো না, ছিলো
আনন্দের। গ্লানি মোচনের।
সব কটা খুনীকে পাকড়াও করা যায়নি রাসেল। বেশ কয়েকজন পালিয়ে আছে বিভিন্ন
দেশে। পালিয়ে থাকা খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। থাইল্যান্ড
আর আমেরিকা দুজন খুনীকে ফেরত পাঠিয়েছিলো। ওদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আমি এখন থাকি পৃথিবীর চমৎকার একটি দেশ কানাডায়। ২০০১ সালে ইলেকশনে
তোমার হাসু আপা পরাজিত হবার পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিশীল
লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীদের ওপরও নেমে এসেছিলো নিপীড়নের
স্টিম রোলার। এর প্রথম দিককার অন্যতম শিকার ছিলাম আমিও। বাধ্য হয়েই
আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়েছিলো তখন, কানাডায়। আমি থাকি কানাডার
রাজধানী অটোয়াতে। পাশের শহর অশোয়ায় তোমাদের হত্যাকারী একজন--খুনী নূর
চৌধুরীও বসবাস করছে। এটা জানার পর থেকে মনটা বিষণ্ন ছিলো। বিক্ষুব্ধ
ছিলো। কানাডা শান্তির দেশ। মানবাধিকারের দেশ। কানাডা খুনীদের অভয়াশ্রম
হতে পারে না। আমরা প্রতিবাদ করেছি। সরকারকে জানিয়েছি। সরকার আমাদের কথা
দিয়েছে তারা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পৃথিবীর উন্নত
দেশগুলোতেও খুনীদের মিত্ররা আছে।
কয়েক মাস আগে তোমার হাসু আপা কানাডায় এসেছিলেন। যে এপার্টমেন্টে তিনি
ছিলেন, তার খুব কাছের আরেকটি এপার্টমেন্টেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা নূর
চৌধুরীর বসবাস। ২৫ মে ২০১১ তে দৈনিককানাডা স্টার একটা প্রতিবেদন
ছেপেছিলো, যার শিরোনাম ছিলো—“বাংলাদেশী পিএম ভিজিটস ফ্যামিলি ইন শ্যাডো
অব কিলার।” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা স্পেন্ডস উইক ইন অশোয়া,
নট ফার ফ্রম ফাদার্স য়্যাসাসিন....।’
রাসেল, তুমি জেনে হয়তো অবাক হবে,আমাদের মন্ত্রীদের কাজ কম কথা বেশি।
আইন মন্ত্রী আর পররাষ্ট্র মন্ত্রী কানাডা সফর করে মিডিয়াকে
বলেছেন—কানাডা নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। কিন্তু
কানাডা জানিয়েছে এমন কথা তারা বলেনি। কী আশ্চর্য! নূরকে ফিরিয়ে নেবার
কাগজপত্র আগে তো সই হোক। তারপর মিডিয়াকে জানাও, তা না। কাজ না করেই
বাকুম বাকুম। এটা তো আর বাংলাদেশ না যে যখন তখন যাকে খুশি আটকে ফেলা
যাবে, দেশ থেকে বের করে দেয়া যাবে, মেরে ফেলা যাবে। এটা কানাডা। নিয়ম
এখানে সবার আগে মান্য। আমাদের বাকপটু মন্ত্রীরা সেটা বোঝেন না।
বন্ধু রাসেল,
পঁচাত্তরের ঘাতকরা তোমার পরিবারের সবাইকেই হত্যা করেছিলো। শুধুমাত্র
দু’জন সদস্য, তোমার হাসু আপা আর রেহানা আপা সেই সময়টায় জার্মানিতে
অবস্থান করছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁদের এই বেঁচে যাওয়াটা কেবল
তাঁদের দু’জনার সৌভাগ্য ছিলো না রাসেল। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে
গিয়েছিলাম আমরাও। বেঁচে গিয়েছিলো বাংলাদেশের মানুষ, পুরো বাঙালি জাতি।
তোমার হাসু আপার কল্যাণেই তো আমরা জীবিত কালেই খুনীদের দম্ভের
সমাপ্তিটা দেখে যেতে পারলাম! কতো বড়ো একটা লজ্জা আর কলঙ্কের হাত থেকে
মুক্তি পেলাম বলো তো!
কিন্তু রাসেল, তোমার হাসু আপার জীবন কিন্তু নিরাপদ নয় এখনও। পঁচাত্তরের
খুনীরা তাদের অসম্পূর্ণ মিশন বাস্তবায়নে এখনো তৎপর। বাংলাদেশটাকে
মুজিবশূন্য করার পর এখন তাদের লক্ষ্য হাসিনাশূন্য বাংলাদেশ। তোমার হাসু
আপাকে হত্যা করতে পারলেই দেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানাতে পারবে ওরা। এই
ক্ষেত্রে সবচে বড় বাঁধা তোমার হাসু আপা। আর সে কারণেই ২০০৪ সালের একুশে
আগস্ট বিকেলে বংগবন্ধু এভিনিউর জনসভায় তৎকালীন সরকারের নিপূন সহযোগিতায়
গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিলো। এই হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হলেও অল্পের
জন্যে বেঁচে গিয়েছিলেন তোমার হাসু আপা জননেত্রী শেখ হাসিনা। একটা
ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তোমার হাসু আপা। আর তখনই একযোগে
শুরু হলো গ্রেনেড হামলা। একটা গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিলো ট্রাকের ওপরে।
সেটা বিস্ফারিত হয়নি। আরেকটা গ্রেনেড সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঠিক
ট্রাকের ওপর না পড়ে গড়িয়ে পড়েছিলো নিচে, যেখানে আইভি রহমানরা বসেছিলেন।
মুহূর্তেই উড়ে গিয়েছিলো আইভি রহমানের পা। আইভি রহমানসহ ২২ জন মৃত্যু
বরণ করেছিলেন ওখানেই। আর আহত হয়েছিলেন শত শত মানুষ। তোমার হাসু আপা
গ্রেনেড হামলার পরও বেঁচে গেছেন বুঝতে পেরেই, যখন তিনি গ্রেনেড ও টিয়ার
গ্যাসের ধোঁয়াচ্ছন্ন ভয়ংকর পরিস্থির মধ্যেই তাঁর গাড়িতে করে নিরাপদ
স্থানে সরে যেতে চাচ্ছিলেন দ্রুত, ঠিক তখনই শুরু হয়েছিলো গুলি। কোনো
কারণে গ্রেনেড হামলায় তোমার হাসু আপা বেঁচে গেলে তাঁকে ওখানেই গুলি করে
খতম করে দেবার জন্যে স্নাইপারও প্রস্তুত ছিলো। কী ভয়ংকর ছক! সেদিন তিনি
নিহত হলে তোমার হত্যাকারীদের কোনো শাস্তিই হতো না এই পোড়ার দেশে। বরং
সূর্য সন্তান বলে সেই ঘাতকদেরই সম্মানিত করা হতো, পুরস্কৃত করা হতো
আবারো ।
বাংলাদেশের আকাশে তাহলে চিরস্থায়ী হতো ঘন-ঘোর অন্ধকার মেঘ। লাল সবুজ
পতাকার বদলে বাতাসে দোল খেতো চানতারা নিশান।
দেখো রাসেল, কেমন দুর্ভাগা আমরা। একটি স্বাধীন দেশে,মুক্তিযুদ্ধের
সরাসরি বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি বারবার আমাদের
ওপর প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। স্বাধীন দেশে ওদের তো জায়গা হবার কথা ছিলো
না। ওদের তো পালিয়ে যাবার কথা! লুকিয়ে থাকার কথা ইঁদুরের গর্তে! কিন্তু
আমাদের নষ্ট রাজনীতি সেই নরঘাতকদের মাথায় তুলে নাচছে! একাত্তর আর
পঁচাত্তরের ঘাতকরা মন্ত্রী হচ্ছে! সারা বাংলাদেশের মাটির বুকে ঘুমিয়ে
আছে তিরিশ লক্ষ শহীদ। সেই শহীদদের বুকের ওপর দিয়ে ঘাতকরা স্বাধীনতার
পতাকাশোভিত গাড়িতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারাদেশ! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
বাংলাদেশের মাটিতে কান পাতো যদি, তুমি কেবল শহীদদের আর্তনাদই শুনতে
পাবে রাসেল!
তোমার হাসু আপার বিপদ দেখো ঘরে বাইরে সবখানে। দেশের এক কঠিন সময়ে, ২০০৭
সালে ‘এক এগারো’র আগমন ঘটলো বাংলাদেশে। নির্দলীয় লেবাসের আড়ালে
খণ্ডকালীন সেনা শাসন কায়েম হলো। সেই সময়টায় তোমার হাসু আপাকে রাজনীতি
থেকে চিরবিদায় এবং বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বের করে দেবার গভীর এক
ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। আর সেই ষড়যন্ত্রে কী অবলীলায় শামিল হয়েছিলেন আওয়ামী
লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও! পঁচাত্তরেও আমরা দেখেছিলাম, তোমার বাবা জাতির
জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবের লাশ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে ফেলে রেখেই
কতিপয় আওয়ামী নেতা খুনী মুশতাকের মন্ত্রী সভায় শপথ নিয়েছিলেন! এক
এগারোর খন্ডিত সেনা শাসনের সময়েও আমরা দেখলাম, তোমার হাসু আপাকে
নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সেনা শাসকদের সঙ্গে গোপনে রফা করেছেন তোমারই
তোফায়েল চাচা, রাজ্জাক চাচা, আমু খালু, জলিল চাচা আর সুরঞ্জিত মেসোরা।
কী ভয়ানক কাণ্ড দেখো রাসেল! কাদের ওপর নির্ভর করবেন তোমার হাসু আপা!
তাঁর চতুর্পাশে কারা এরা! তোমার হাসু আপাকে বুক দিয়ে আগলে রাখার কথা তো
এদেরই!
২০০১ সালের মধ্য জুনে আমার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে তোমার হাসু আপা আমাকে
বলেছিলেন যে চারপাশে সর্প নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। সুযোগ পেলেই ছোবল
দিচ্ছে সাপ। দংশনে দংশনে নীলকণ্ঠ তিনি। সেদিন আমি পুরোপুরি বুঝতে
পারিনি তাঁর কথার মর্ম। এক এগারোর পরে বুঝেছিলাম। সত্যি বলতে কি রাসেল,
বড্ড নিঃসংগ তোমার হাসু আপা। জনারণ্যে একা তিনি।
অনুজপ্রতীম বন্ধু রাসেল,
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের সেই কালরাতে তোমার বয়েস ছিলো এগারোর
কাছাকাছি। ভয়াল সেই রাতের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে তেরো বছরের বেবী, দশ
বছরের আরিফ, এবং চার বছরের সুকান্তও নিহত হয়েছিলো। একজন শিশুর
স্বাভাবিক মৃত্যুতেই কেঁদে ওঠে ধরিত্রী বসুন্ধরা। চারটি শিশুর এমন
মৃত্যুতে ধরিত্রী কি বিলাপ করেছিলো সেই রাতে? অমানবিক নৃশংসতার শিকার
এই চারজন নিষ্পাপ শিশুর প্রতীক হিশেবে তোমাকে নির্বাচন করে ছোটদের
কাগজের সেই বিশেষ সংখ্যায় তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠির শিরোনামটি
ছিলো--‘শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা।’ আমার লেখাটির সঙ্গে
একটা ছবি ছিলো তোমার। একটা তিনচাকার সাইকেলে বসে আছো তুমি।
আজ তোমাকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখতে গিয়ে বারবার আমার কেবল মনে পড়ছে তোমার
সাইকেলটির কথা। তিন চাকার বেবী সাইকেল। কিড়িং কিড়িং বেল বাজিয়ে ঘর
বারান্দা উঠোন লবি চষে বেড়াতে তুমি। কোক পটেটো চিপস আর টিকটিকির ডিম
(স্মার্টি) ভীষণ পছন্দ ছিলো তোমার। আমার কন্যা নদীরও ছেলেবেলায় ভীষণ
প্রিয় ছিলো এই টিকটিকির ডিম। নদীর জন্যে নানান বর্ণের খুদে খুদে
টিকটিকির ডিমের প্যাকেট কিনতে গিয়ে কতোদিন যে তোমার কথা মনে পড়েছে
আমার!
শুনেছি খুনীরা একে একে তোমাদের পরিবারের সবাইকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা
করার পর সবার শেষে হত্যা করেছিলো তোমাকে। তুমি কাঁদছিলে। মায়ের কাছে
যাবো মায়ের কাছে যাবো বলে কাঁদছিলে তুমি। কাঁদবেই তো। তুমি তো বন্ধু
মায়ের কাছেই যেতে চাইবে। মায়ের বুকের উষ্ণতা আর মায়ের গায়ের গন্ধই তো
তোমার সবচে প্রিয় হবার কথা। খুনীরা সবাইকে শেষ করার পর তোমাকে
পেয়েছিলো। তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। তোমার বাবার লাশ, ভাইদের
লাশ, ভাবীদের লাশ অতিক্রম করে তুমি পৌঁছে গিয়েছিলে মায়ের লাশের কাছে।
মায়ের লাশের পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে তোমার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি
করেছিলো মানুষরূপী একটা পশু। রক্তাক্ত তুমি কি লুটিয়ে পড়েছিলে মায়ের
লাশের ওপর? শেষ মুহূর্তে কি তুমি মায়ের বুকের উষ্ণতাটুকু পেয়েছিলে
বন্ধু? শেষ মুহূর্তে তোমার মায়ের গায়ের গন্ধ কি পেয়েছিলে তুমি?
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে ঢুকলেই আমি ছোট্ট তিনচাকার সাইকেলের
কিড়িং কিড়িং বেল-এর শব্দে সচকিত হয়ে উঠি। আমি টের পাই, এইমাত্র আমাকে
পাশ কাটিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে গেলো একটা ছোট্ট সাইকেল। আর সাইকেলের
চালকের আসনে ছোট্ট এইটুকুন একটা ছেলে। ছেলেটার পরনে একটা রক্তে ভেজা
জামা। ছেলেটা কাঁদছে—আমি মায়ের কাছে যাবো। মায়ের কাছে যাবো। আহারে!