[প্রথমপাতা]
|
ধারাবহিক উপন্যাস-ওইখানে যেওনাকো তুমি (দ্বিতীয় পর্ব)
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
২.
সেদিন থেকে রূপার মা আর আফজালের এই বাড়িতে ঘন ঘন আসাটা পছন্দ করেন না।
রূপাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন আর কখনো যেন তার সাথে রিকসায় না উঠে। এক সময়
রূপার মায়ের দিকেও কেমন চোখে তাকাত ঐ আফজাল। এত মিষিট করে কথা বলে যে তার
মত ফেরেস্তা আর নাই। রূপার বাবা এসবের ধার ধারে না। তাকে বলতে গেলে সে জবাব
দেয়,কি যে বলো না তুমি রূপকের মা,আফজাল হল আমার ভাইয়ের মত। সে রূপাকে মেয়ের
মত আদর করে। আর রূপা একটা বাচ্চা মেয়ে ,আফজাল ওর সাথে কি করবে ,কেনই বা
করবে ?
আসলে একজন বাবা তার নিজের কন্যাকে যে দৃষ্টিতে দেখেন, সে দৃষ্টিতে জগতের আর
কোন পিতৃতুল্য ব্যক্তিই কোন কন্যাকে দেখে না। দেখতে তারা পারে না। কারন
তাদের সকলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পুরুষালী বৈশিষ্ট্য । যে কোন মেয়েকে,হোক সে
শিশু কিংবা বৃদ্ধ,রানী কিংবা চাকরানী,তাকে বাস্তবে না হোক, চোখ দিয়ে তারা
লেহ্যন চোষণ চর্বণ এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত করতে ছাড়ে না।
রূপার মা বরং মেয়েকেই সাবধান করে দেন। মেয়েদের পদে পদে বিপদের আশঙ্কাগুলোর
কথা খুব যতœ সহকারে মেয়েকে বুঝান। এখন থেকেই একটু একটু করে মেয়েকে বুঝাতে
হবে তার চলার পথে কত কত কাটা বিছানো থাকবে ,আর সেগুলো কিভাবে উপড়ে ফেলে
কদমের পর কদম এগিয়ে যেতে হবে। আরো বলে দিলেন কখনো কোন পুরুষ মানুষের সাথে
এক রিকসায় উঠবে না ,একা কোথাও যাবে না,কেউ ডাকলেও না ,সে চাচা ,মামা
খালু,শিক্ষক যাই হোক না কেন। নিজের বাবা এবং ভাই ছাড়া সব পুরুষই মেয়ে
মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এরা চাচা মামা দাদু হয়ে বাচ্চা মেয়েদের সাথেও
অন্তরঙ্গ মুহুর্ত স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে বা জাগ্রত নয়নে।
গরম ভাত খেয়ে চুলে সাদা ফিতে দিয়ে দুটো বেনী করে স্কুলের পোশাক পড়ে কাঁধে
বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে রূপা ঘর থেকে নামে। ঘন কুয়াশায় দশ হাত সামনের কিছুও
দেখা যাচ্ছে না। দাঁতের দু’পাটি খানিক পরপর একটার সাথে আর একটা বাড়ি খাচ্ছে
শীতের প্রকোপে। তুলিদের বাড়ির সামনে এসে দুটি ডাক দিতেই কুয়াশার মধ্য থেকে
তুলির ছায়াটি আবছা থেকে স্পস্ট হয়ে উঠল। দু’জনে ছোট ছোট কথা বলতে বলতে
হেঁটে চলল। একজন দু’জন করে নীল সাদা পরিহিতা তরুনীর সংখ্যা বেড়ে চলল। এ
দৃশ্যটা দেখতে বড়ই মনোরম লাগে। এক ঝাঁক তরুনী সকালের øিগ্ধ আলোয় দল বেঁধে
স্কুলে যাচ্ছে। সাদা নীল পোশাকে চোখ বাঁধা পড়ে যায়।
রাস্তায় যেতে যেতে কত দৃশ্যই রোজ দেখে রূপা। কোনটা দেখে মনটা দুলে উঠে
আনন্দে ,আবার কোনটা দেখে রাগ হয়,ঘৃনা হয়,লজ্জা হয়। কিছু জিনিস দেখলে বা
শুনলে মনটা বিষিয়ে ওঠে । প্রতিবাদ করতে মন চায় ,কিন্তু পারে না। তবে যাই
হোক, ভাল কি মন্দ ,সবকিছু মাকে না বলা পর্যন্ত রূপার মনে শান্তি হয় না।
রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালের পানিতে ভেসে যাওয়া খড়কুটোও রূপা
অবাক হয়ে দেখে। কখনো দেখে কচুরিপানার ভেসে যাওয়া। ছোট ছোট ছেলেদের মাছ ধরা
,ফড়িং ধরা । রাস্তার পাশে বাড়িগুলোর সামনের মাঠে ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলা
দেখে রূপার মনে উৎসাহ যেন উপচে পড়ে। মন চায় সেও হাতে র্যাকেট নিয়ে ওমন করে
খেলে। কিছুদিন আগেও সে বড় দু’ভাইয়ের সাথে জোছনা রাতে ঘরের সামনের উঠানে
ব্যাডমিন্টণ খেলত।
ইদানীং রূপার সেসব খেলায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে। উঠানে খেলতে দেখলেই মা বলেন এখন
থেকে তুমি আর ব্যাডমিন্টন খেলবে না রূপা। তুমি এখন বড় হচ্ছ। ওমা বড় হওয়ার
সাথে ব্যাডমিন্টন খেলার কি সম্পর্ক ? রূপা আশ্চর্য হয়। মাকে প্রশ্নটা করেও
বসে। মা বলেন ,মেয়েরা বড় হলে দৌঁড় ঝাঁপ দেয়ার মত খেলাধুলা করতে হয় না। মানে
যে খেলায় শরীর দুলে উঠবে সে খেলা বারণ। এর সাথে বন্ধ হয়ে যায় রূপক ভাইয়ের
লাল সাইকেলটা চুরি করে চালানো। ভাইয়ের আড়ালে সুযোগ পেলেই রুপা সাইকেলটা
নিয়ে উঠানে দুটো চক্কর দিত। একদিন মা বললেন,রুপা তুমি আর কখনো সাইকেলে
চালাবে না। রূপার মনে ভেসে ওঠা প্রশ্নটা চোখের দৃষ্টিতে বুঝে নিয়ে মা জবাব
দেন , মেয়েদের সাইকেল চালাতে নেই।
এমন করেই দিনে দিনে রুপার প্রতি নিষেধাজ্ঞার ফর্দটা লম্বা হতে থাকে , আর
ছোট হতে থাকে রূপার মনটা। কেন সে বড় হচ্ছে আর কেনই বা তার উপর এতসব বিধি
নিষেধ আরোপ হচ্ছে ! যেসব বিধি নিষেধ তার মানতে ইচ্ছা করছে না। অথচ মায়ের
কথার অবাধ্য হতে সে পারে না। কৈ, বড় ভাইদের উপর তো কোন বিধি নিষেধ নাই।
তারাওতো মায়ের চোখের সামনে দিয়েই তরতর করে বড় হয়ে উঠছে। তাদের তো মা বলেন
না বাইরে যেও না,গাছে ওঠ না,সাইকেল চড় না, উচ্চস্বরে কথা বল না। রুপার
বেলাই এটা খেল না ওটা কর না,সাঁতার কেট না,গাছে চড় না,সাইকেল চড় না ,চুল
খুলে বাইরে যেও না,হাঁটুর নিচে খালি রেখ না। আরো কত কি।
শীত গিয়ে গ্রীষ্ম এল । রূপা নতুন ক্লাসে উঠল । স্কুলে আসা যাওয়ার পথে কখনো
ভাইদের সময়ের সাথে সময়টা মিলে গেলে ওরা রূপাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে বাড়ি
নিয়ে আসে। একপাশে দু’পা ঝুলিয়ে রূপা পিছনে চুপটি করে বসে থাকে। মাঝে মাঝে
ইচ্ছা করে বড় ভাইকে ওমন পিছনে বসিয়ে রূপা সাইকেলটা চালিয়ে বাড়ি চলে আসে।
একদিন সেটা বলতেই রূপক বলে, তোর কি মাথা খারাপ হল নাকি ? তুই রাস্তায়
সাইকেল চালাবি ?
কেন ,তুমি চালাতে পারলে আমি কেন পারব না ভাইয়া ?
একথা মা শুনলে তো ঠ্যাং দুটি ভেঙে দিবে বুঝলি ? মেয়েরা রাস্তায় সাইকেল
চালায় না। কাউকে দেখিস চালাতে ?
চালায় না, কারন তারা পারে না। আমি তো পারি।
ভদ্র মেয়েরা কখনো এসব কাজ করে না ।
সাইকেল চালানোর মধ্যে আবার অভদ্রতার কি আছে ভাইয়া ? আমি তো দেখছি না কিছু ।
তর্কে তর্কে ভাই বোন বাড়ি পৌছে। কিন্তু মিমাংসা আর হয় না। বড় ভাইয়ের যুক্তি
রূপার কাছে অগ্রহনযোগ্যই থেকে যায়।
তুলিদের বাড়ির সামনে এসে দুটো ডাক দিতেই তুলি এসে হাজির। কিন্তু পড়নে
স্কুলের পোশাক নেই। হাতেও নেই বইয়ের ব্যাগ।
কি রে তুলি ,স্কুলে যাবি না আজ ?
না রে । আজ তুই একাই যাস । আজ আমার বড় আপুকে দেখতে আসবে । তাই মা আমাকে
বাড়ি থাকতে বলছে।
দেখতে আসবে মানে ? কে দেখতে আসবে ? কেন দেখতে আসবে ?
আরে বুঝলি না ? আপুর বিয়ের কথা চলছে তো। তাই পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে । দেখে
পছন্দ হলে বিয়ে হবে।
ওহ আচ্ছা । তাহলে আমি যাই।
বলে রূপা আবার থামল।
শোন তুলি,তোর বড় আপুকে যখন দেখতে আসবে আমাকে একটু ডাকবি ?
কেন তুই কি করবি এসে ?
এমনি দেখতাম আর কি,এই দেখতে আসা তো কখনে দেখিনি তাই।
আচ্ছা তুই বিকেলে চলে আছিস। স্কুল থেকে এসেই আমাদের বাড়ি চলে আসবি ।
সন্ধ্যের আগেই ওনারা আসবেন।
রূপা সেদিন অন্যদের সাথে স্কুলে যায়। সারাদিন ওর মনের মধ্যে কৌতুহল তুলির
বড় আপুকে কারা দেখতে আসবে,এসে কি করবে,এমনি নানান প্রশ্ন। কখন স্কুল ছুটি
হবে কখন সে তুলিদের বাড়ি যাবে।
বসার ঘরে পাত্র পক্ষ বসে আছে সারিতে সারিতে। পাত্র ,পাত্রের
বোন,দুলাভাই,বন্ধু,মামা,চাচী আরো না জানি কারা কারা। সবাইকে তুলি চিনে না।
তাই রূপাকেও চিনিয়ে দিতে পারেনি। বসার ঘরের পাশের ছোট্ট ঘরটির জানালার
পর্দা সরিয়ে ওরা অনুষ্ঠানটি পর্যবেক্ষন করছিল।
ঘরে মধ্যে চামচ বাটি পিরিচের টুং টাং শব্দ,আর মেয়ে মানুষদের ফিসফাস।
জর্দ্দা সেমাইয়ের মৌ মৌ ঘ্রান। তুলির মেঝ আপা শিলা যতেœর সাথে শরবতে লেবু
চিনি মেশাচ্ছে।
সেই মহেন্দ্রক্ষণ এল। হাতে ট্রেতে করে শরবতের গ্লাস সাজিয়ে শাড়ি পড়ে ঘোমটা
টেনে নীরা প্রবেশ করল । একসাথে অনেক গুলো চোখ নীরার মুখের উপর। প্রথমে
মুখমন্ডল, তারপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকলের দৃষ্টি নীরার উপর। নীরার ফুপি
উঠে গিয়ে ট্রে টা নীরার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে নীরাকে হাত ধরে বসাল।
নীরা যেন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসা রোগী। ধরে বসাতে হবে। তারপর অবনত মাথায়
মাটির দিকে চোখ করে বসে থাকা। যদিও নীরা এ জলসায় উপস্থিত হয়ে কোন অপরাধ
করেনি। তারপরেও তাকে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে লজ্জাতুর নয়নে বসে থাকতে
হবে। লজ্জাটা আবার থাকা জরুরী। বিয়ের কনের লজ্জারাঙ্গা মুখ না হলে সে কি
বিয়ের কনে হয় ?
শরবতের পেছন পেছন আরো সব খাদ্য সামগ্রী আসতে থাকল। চামচ আর পিরিচের টুং টাং
শব্দ রইল কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে নীরার ইন্টারভিয়্যূ পর্ব শুরু হয়ে গেছে।
নীরার হাতেও নাশতার অংশ বিশেষ উঠল। কেউ তাকিয়ে দেখছে নীরা কেমন করে চামচ
দিয়ে মিষ্টিটা কাটছে,কেমন করে হা করে মুখে পুড়ে চিবোচ্ছে। সবই তো দেখতে
হবে। হা করলে মুখটা কতখানি বড় হয় তাও দেখার বিষয়। মেয়েদের কুমিরের মত বড়
মুখ হলে দেখতে ভাল লাগে না। হতে হবে তেলাপিয়া মাছের মত গোলগাল ঠোঁটের আবরনে
ছোট খাট একটি মুখ। জিহবাটা হতে হবে লাল ,পাতলা এবং সরু। দাঁতগুলো থাকবে
পাটির মত বিছানো এবং মুক্তার মত ঝকঝকে সাদা ।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|