প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

ধারাবাহিক গল্পঃ
হরিদাসের রমজান মাস

 

 

শাশ্বত স্বপন

 

শেষ পর্বঃ হরিদাসের অগস্থ্য যাত্রা

["এরকম অনেক রোজাই সে করেছে আল্লাহকে খুশি করার জন্য, কারণ যে আল্লাহ সেইতো ভগবান। সবাই মনে করত, হরি উপাস আছে কিন্তু উপাসে ফল-ফলাদি খাওয়া যায়, রোজা রাখলে ইফতার এর আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া যায় না। হরি ইফতারের আগে কিছুই খেত না। তার ইফতার খাওয়া দেখলে মনে হতো সেই প্রকৃত রোজদার। কেউ কেউ এ বিষয়টা জানত কিন্তু আলোচনা করত না। বাজারের সবাই হরিকে ভাল জানত। এই রোজায় সে ইফতারের নানান খাবার নানান হাঁট থেকে কিনেছে। হরি ভাবছে, আর একদিন সময় পেলে হাট থেকে কেনা সব ইফতারী মাল মুসল্লিদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া যেত।" ]
 
‘রোজাদারেরা ওঠো--, সেহরীর সময় অইছে...।’ এ রকম আহবান সারা জীবন সে শুনতে পেয়েছে, বিশেষ করে যেদিন দোকানে ঘুমাত। এই রাতে হরি শুনতে পেল না। গ্রামে কারো ঘরে ঘুম থেকে উঠার শব্দ, সেহেরীর খাওয়ার শব্দ সে শুনতে পেল না। কাক-জ্যোৎন্সা । দিঘলী বাজারের পাহাড়াদারের চিৎকার, দরজা বা দোকানের ঝাপের আওয়াজ কিছুই শুনতে পেল না। সবাই পালিয়েছে, কেউ কি রোজা রাখে না? আজ অবশ্য নিয়ত না করেই হরির পুরো পরিবার রোজা। না খেয়েই তারা ঘর থেকে বের হয়েছে। সবাই হয়তো সময়ের আগেই রোজা ভেঙ্গে ইফতার করবে কিন্তু হরি করবে না, সে আজ না খেয়েই থাকবে। এরকম অনেক রোজাই সে করেছে আল্লাহকে খুশি করার জন্য, কারণ যে আল্লাহ সেইতো ভগবান। সবাই মনে করত, হরি উপাস আছে কিন্তু উপাসে ফল-ফলাদি খাওয়া যায়, রোজা রাখলে ইফতার এর আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া যায় না। হরি ইফতারের আগে কিছুই খেত না। তার ইফতার খাওয়া দেখলে মনে হতো সেই প্রকৃত রোজদার। কেউ কেউ এ বিষয়টা জানত কিন্তু আলোচনা করত না। বাজারের সবাই হরিকে ভাল জানত। এই রোজায় সে ইফতারের নানান খাবার হাঁট থেকে কিনেছে। হরি ভাবছে, আর একদিন সময় পেলে নাওডোবা হাট থেকে কেনা সব ইফতারী মাল মুসল্লিদের কাছে বিলিয়ে দেওয়া যেত। হরি বড় দোকানের ঝাপে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ডাকতে লাগল, নিতুন, শংকর, মোসলেম, উঠ। আরো কয়েকবার আঘাত করেও কোন লাভ হল না। নিচে তাকিয়ে দেখে তালা দেওয়া। জ্যোৎস্নায় আলোয় ঝাপ-তালা-গলি কিছুই সে ভালভাবে চিনতে পারছে না।

অবিশ্বাস চোখে বলল, দেখ তো, এটা আমাদের দোকান কিনা? সবাই হ্যাঁ বলার পর নিজের মনে বলে উঠল, পালিয়েছে, সবাই পালিয়েছে। মালগুলো বাইরে রাখলে সবাই ইফতারে খেতে পারত। হরি নদী পথের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। তার পা চলতে চাইছে না। স্ত্রী-পুত্র-ভাতিজা-ভাতিজি-আত্নীয়-স্বজন--এদের অনুরোধে সে চলছে, বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। কে যেন বলছে,‘ হরি যাসনে, ফিরে আয়, তুই চলে গেলে আমাদের কি হবে?’ হ্যাঁ, বাবা, ঠাকুরদাদাই তো ডাকছে। স্ত্রীকে বলছে, ‘সবিতা, তুমি কি বাবার ডাক শুনতে পাও।’ ‘না, চল, তাড়াতাড়ি নদী পার হতে হবে।’ হরিকে সবাই যেন ধাক্কা দিয়ে নিয়ে চলেছে। বাজারের সাথে শুকনো নদী, এক গিঁড়া জল। হরি দেখে তার অন্তরে প্রবাহিত নদীর মত এ নদীও শুকিয়ে গেছে। নদী পার হলেই দখিনে দীর্ঘ বালুচর। বালুচরের ফাঁকে ফাঁকে খুব বেশি চোখে পড়ে পিয়াজ, রসুন, ধান, নদীর কূল জুড়ে নটে আর কাশ জাতীয় ঘাসের বিশাল সীমানা। টিন-ছন-কাঁশ-মুলি বাঁশ দিয়ে ছবির মত করে গড়া চরের ঘরগুলোর চারপাশে কলাগাছ, কোথাও একটি, কোথাও দুইটি ঘর, আবার বেশ দূরে একটি-দুইটি ঘর। এরা যেন ছবি, এদের কোন ভয় নেই। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর বাদুরের পাখা ঝাপটানি চরের রাতের পরিবেশকে ভুতুরে করে দেয়। চরে কলাগাছ বেশি বলেই বাদুরের ওড়াওড়ি চোখে পড়ে।

পরিবারের ছোট বাচ্চারা হাসছে। পঠিংকুমার আর আলকাতরা পরীকে তারা চিনে। সোরাব মিয়া বানরদের নিয়ে চর পার হচ্ছে। হরি কাক-জ্যোৎন্সায় বাড়ি থেকে বের হলেও কাক-ভোর বা ভোরের হাঁট যাত্রীরা তাদেরকে অতিক্রম করে চলেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দেশের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাদাম বিক্রেতা রফিক বলল, ‘কাকা সপরিবারের বানিজ্যে যাচ্ছেন?’ ‘হ্যাঁ রে রফিক, রাজবাড়িতে আমাদের আত্নীয়-স্বজন থাকে , ওদেরকে ওখানে রেখে পরদিন নাওখোলার হাঁট ধরব।’ সোরাব মিয়া বলছে, ‘চাচা, এবার ঈদে কিন্তু আমার পঠিংকুমাররে ধুতি-পায়জামা আর আলকাতরা পরীরে বেনারশী শাড়ী দিবেন, আপনে কইছিলেন। এবার ওদের নিকা দিব।’ বাদাম বিক্রেতা সাত্তার বলে উঠে, কও কি সোরাব ভাই, জামাতী হুজুররা জানলে, তোমার আলকাতরা পরীরে তুইললা ম্যালেটারীগো কাছে লইয়া যাইব, বেশরীয়তি কাজ-কাম, অহনো নিকা দেও নাই, এক লগে থাকে কেমনে? সবাই ওর কথা শুনে হাসতে শুরু করল।

হরি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দিঘলী বাজারটা ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল। সারা জীবনের স্মৃতি, তার শিশুকাল-স্কুল-বাজার-বাড়ি-মন্দির-পুকুরঘাট-ফসলের মাঠ সব চোখের জলে ভাসছে। সে যেন, ঐ মাটির সাথে লেগে থাকা অংশ। এরা যেন, তাকে সেই মাটি থেকে খাবলা দিয়ে নিয়ে এসেছে। পূর্ণিমার শেষ রাত, তারাগুলো মিটি মিটি জ্বলছে, চাঁদও চলেছে তাদের সাথে। অথচ এত ফকফকা চাঁদনী রাতেও হরি চোখে কিছু দেখতে পায় না। সে স্ত্রীকে বলেই চলেছে, সবিতা, সামনে সব অন্ধকার, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, হাঁটতেও পারছি না। সবাই হরিকে ঘিরে কাঁদতে শুরু করল। হরি যেন, স্বপ্নের হাত ধরে ঘোর অমাবশ্যার অন্ধকার রাতে বঙ্গভুমির পাঁচ পুরুষের ভিটা ছেড়ে দিগন্তবিহীন বালুপথে ভেসে চলেছে।


 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ