[প্রথমপাতা]
|
ধারাবহিক উপন্যাস-ওইখানে যেওনাকো তুমি (তৃতীয় পর্ব)
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
৩.
নাশতার পর্ব শেষ হল। এবার নীরার আসল পরীক্ষা শুরু। নাম ধাম,পড়াশুনা,সেলাই
,গান বাজনা,রান্না বান্না ,আচার ব্যবহার সব নিয়েই কথা হল। কেউ কথার ছলে
চুলটা দেখে নিল । হাতের নখ,পায়ের গোড়ালি কিছুই বাদ রাখেনি। চোখের পাতায়
লজ্জার আবরণটা নীরাকে বড় মায়াবী করে তুলছে।
সবকিছু দেখা হলে পাত্র তার বোনের কানে কানে কিছু একটা বলে।
বোনটা এদিক ওদিক চেয়ে তারপর নীরার দিকে তাকিয়ে বলে আপনার কি কিছু বলার আছে
?
নীরা একটু চুপ করে থাকে। যেন সে একটা সুযোগ পেয়েছে। না সে সুযোগ পায়নি
,তাকে সুযোগ দিয়েছে ওপক্ষ। সুযোগ পেয়েও নীরা মাথা নেড়ে বলল,তার কিছু বলার
নাই। যা বলার বাবা মা বলবেন।
সবার সম্মতি নিয়ে নীরার ডান হাতটা বের করে অনামিকায় স্বর্নের আংটি পড়িয়ে
দিল পাত্র নিজে। হাতটা এগিয়ে ধরল বোন , আর হাসিমুখে আঙ্গুলে আংটিটি পড়িয়ে
দিল ভাই ।
নীরাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল।
রূপা বাড়ি এসে গড় গড় করে সব কাহিনী মাকে বলে গেল।
সে রাতে ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা।
রূপার কাছে সেটা বড় এক দুর্ঘটনাই বটে। এতদিন যত বিধি নিষেধ তার জীবনে আসছিল
এখন তার চেয়ে আরো হাজারো গুন বেশি বিধি নিষেধ তার দু’কান ঝালাপালা করতে
লাগল।
ঘুমের মধ্যে শেষ রাতে শরীরের কেমন অস্থিরতায় রূপার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই শরীর থেকে পানির মত কিছু বের হয়ে নিুাংশ ভিজে যাওয়া টের
পেয়ে রূপা আলো জ্বেলে ভয়ে আতংকে চিৎকার করে মাকে ডেকে তুলল। রূপা জানে
‘রক্ত মানেই দুর্ঘটনা’।
আর এর সাথে আরো কত যে দুর্ঘটনা রূপার জীবনে জড়ো হতে থাকল তার হিসাব নাই।
সেদিনই প্রথম মা বললেন,আজ তোর স্কুলে যেতে হবে না। এ অবস্থায় বন বাদাড়
পেড়িয়ে এত দূর স্কুলে যাওয়ার কোন দরকার নেই। গোবর পাড়াবি না,থালা বাটি ছুবি
না,শেষ বিকেলের পর আর বাইরে যাবি না,নামাজের বিছানা ছুবি না,বাবার বিছানায়
ভাইদের বিছানায় বসবি না। আরে এ কি জ্বালার মধ্যে পড়লাম রে বাবা ! এমনিতেই
কষ্টের শেষ নেই,কেমন গা ঘিন গিন করে সারাক্ষন,তার উপর আবার নিষেধাজ্ঞার
জোয়ার এসেছে যেন।
সেই ঘটনার পর রূপাকে একদিন মা নতুন এক জোড়া স্যালোয়ার বানিয়ে দিলেন।
বললেন,এখন থেকে আর হাফপ্যাণ্ট পড়বে না। স্যালোয়ার পড়বে। রুপাতো আশ্চর্য
কিছু কম হল না। এতদিন পৌষ মাঘ মাসে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে রুপাকে সকাল
বিকাল স্যালোয়ার পড়তে হত। আর যখন হুজুরের কাছে আরবী পড়ার সময় হত তখন সে
স্যালোয়ার পড়ত। এখন কাঠ ফাটা গ্রীষ্মের এই মধ্য দুপুরে মা গোসল করে
স্যালোয়ার পড়ার নির্দেশ দিলেন। মায়ের হলোটা কি ?
শীতের হাত থেকে রক্ষা করতে নয়,তাহলে কার হাত থেকে রক্ষা করতে এই ব্যবস্থা ?
মায়ের কথার অবাধ্য সে হতে পারেনি। গোসল করে স্যালোয়ার পড়ে ঘরে এল। গরমে
হাপিত্যেশ অব¯থা। গায়ে রাখতে ইচ্ছা করছে না ওটাকে। হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই
পায়ের নিচে পড়ে যায়। এরই মধ্যে স্যালোয়ারের বন গিট পড়িয়ে বাথরুমে বসে
চেচিয়ে পাড়া গরম করেছে রূপা।
মা দৌঁড়ে আসেন,আরে এমন চিৎকার করতে তোর লজ্জা করে না ? স্যালোয়ারের ফিতেটা
খুলতে পারিস না ঠিক মত ?
দাঁত দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে ফিতের গিট খুলে দেয় মা।
রূপা বলে,মা এগুলো আমি আর পড়ব না। আমার ভাল লাগে না।
তোমার ভাল না লাগলেও এসবই তোমার এখন থেকে পোশাক। তুমি এখন আর খুকি নও যে
হাটু দেখিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নেচে বেড়াবে।
মায়ের কথাগুলো রূপার শুনতে একটুও ভাল লাগছে না। বড় হয়ে তার স্বাদ আহলাদ সব
দেখছি ধুলায় মিটিয়ে যাচ্ছে। এখন কি একটা উটকো ঝামেলা শুরু হল। প্রতি মাসে
এই জ্বালাময় দিন কটি রূপার অসহ্য লাগে। এর কিছুদিন পরই মা রূপাকে ওড়না
ধড়িয়ে দিলেন। রূপার পছন্দের ফ্রোকগুলি সব বাতিল বক্সে ঢুকে গেল। আরো কত কি
যে তাকে দেখতে হবে ! অথচ বড় দুটি ভাই কেমন করে স্কুল পেরিয়ে একজন কলেজে
গেল,আর একজন যাবে যাবে করছে। তাদের বেলায় কোন নিয়মের হেরফের হল না। যেমন
ছিল তেমনি আছে। আর আমার বেলায়ই সব কিছু পরিবর্তন।
সেদিন পাত্রপক্ষ নীরাকে দেখে যাওয়ার পর থেকে এখন তুলি আর রূপার পথগল্পের
বিষয় হয়ে উঠেছে নীরা আপুর বিয়ে। নীরার হবু বরের নাম তপু। এখনি সে নীরা এবং
তার পরিবারকে আপন করে নিয়েছে। ফোন করে সবার সাথে কথা বলে। নীরার কলেজ গেটে
প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দ’ুজনে নদীর ধারে গিয়ে গল্প করে।
সারারাত তার বার্তায় প্রেম করে রাতখানি পার করে নীরা তার হবু বরের সাথে।
দু’জনের মন দেয়া নেয়া যখন তুঙ্গে ,তখন একদিন দু’পক্ষের মুরুব্বিদের বৈঠক
বসল। প্রসঙ্গ ‘বিয়ের দেন মোহর এবং দেনা-পাওনা’ । নীরার বাবা চায় দেন মোহর
তিন লক্ষ টাকা ধার্য করা হোক এবং তার পুরোটাই নগদ উসুল করতে হবে। নীরার
বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা,হজ্জ্ব পালন করা একজন মুসুল্লি। তার মতে
দেনমোহরের টাকা বাকি রাখা ইসলামী শরীয়াহ্ মোতাবেক অন্যায্য। তাই তা বিয়ের
দিনেই পাত্রীকে হস্তান্তর করতে হবে। এদিকে এই শর্ত কিছুতেই মেনে নিতে রাজি
নয় তপুর বাবা। প্রথমত সে দেনমোহর এর অংকটা কমাতে চাইছে। এবং দ্বিতীয়ত নগদ
দেয়ার বিধান সে মানবে না। তার বাপ দাদার আমল থেকে এভাবেই বিয়ে দেখে আসছে
তারা,যে দেনমোহর শুধু মুখে মুখেই থাকে। কেউ কেউ বিয়ের রাতে বৌ এর কাছে চুপি
চুপি ওই টাকা মাফ করে দেয়ার অনুরোধ করে। কী লজ্জার কথা ! বিয়ের রাতেই বৌ এর
কাছে টাকা দিতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা !
নীরার বাবা পাত্রপক্ষের কথায় ক্ষেপে উঠলেন। এসব মাফ চাওয়ার কোন ভিত্তি নেই।
মুসলিম বিবাহ আইনে দেনমোহর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটা মুখে মুখে মাফ
করে দেয়ার মত এত সামান্য নয়। এটা পরিশোধ করা প্রতিটি পুরুষের একান্ত
দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আর এই দেনমোহর কোন ভিক্ষা নয় যে মেয়েরা তা মাফ করে
দিবে। এটা কনের অধিকার। আর তাকে এটা দিতেই হবে। নীরার বাবা বেঁকে বসলেন।
তার কথামত কাজ না হলে সে এই পাত্রের সাথে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দিবে না।
ওদিকে এসব কথা বাইরের ঘর থেকে ভেতরের ঘরে যেতে বেশিক্ষণ লাগল না। নীরা
কেঁদেকেটে বালিশ ভিজাল। তপু ছাড়া সে কাউকেই বিয়ে করবে না। এই অল্প ক’দিনে
তপু তার অন্তরে প্রবেশ করেছে। সর্বত্র এখন তপুর উপস্থিতি। দেনমোহরের কারনে
বিয়ে ভেঙে যাবে, এটা নীরা কি করে মানবে ? সে ফোনে সব খবরা খবর তপুকে
পৌঁছাতে থাকল।
তপু,তুমিকি তোমার বাবার কথা মেনে নিবে ? তোমার বাবাকে বল না আমার বাবার
শর্ত মেনে নিতে ?
-দেখ নীরা আমিওতো তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া আমিও অন্য কাউকে বিয়ে
করতে পারব না। কিন্তু এখন বাবার কথার অবাধ্য কি করে হই ? আমি কিছু বলতে
গেলেই বাবা বলবেন বিয়ের আগেই আমি তোমাদের পক্ষ নিচ্ছি ।
কিন্তু দেনমোহর বিষয়ে বাবার কথার সাথে তোমরা একমত হতে না পারলে যে বাবা এই
বিয়েতে রাজি হবেন না। তখন কি হবে ?
চোখের পানি নাকের পানিতে নীরা একাকার।
তপু বলল,তোমার বাবাকে বল শর্ত কমিয়ে আনতে । আমি না হয় কিছুটা শোধ করব আর
কিছু বাকী থাকল।
নীরা থেকে মায়ের হয়ে এই প্রস্তাবটা বাবার কাছে ঁেপৗছল। বাবা মেয়ের মনের
অবস্থা বুঝতে পেরে রাজি হলেন। কেনাবেচা চলল আরো কিছুক্ষন। তারপর একটা রফা
হল।
এরপর উঠল দেনা পাওনার বিষয়। মেয়ের বাবার কাছে তারা কিছু চায় না। কিন্তু
সমাজে তাদের একটা ইজ্জত আছে। আর সেই ইজ্জত রক্ষার্তে মেয়ের সাথে কিছু ঘর
সাজানোর সামগ্রী যাবে না ,সেটা কি করে হয়। পাড়া পড়শী বৌ দেখতে এসে অন্য
কিছু দেখবে না, সে কি হয় নাকি ? যেন বৌ দেখার সাথে অন্য কিছু দেখাতেই হবে।
বরের বোনেরা সবাইকে আঙ্গুল তুলে ধরে ধরে দেখাবে এগুলো ভাবীর বাবা দিয়েছেন।
এটা না দেখাতে পারলে সমাজে তাদের মান থাকে না। তারপর বিয়ের আাসরে পাত্রের
গলে শ্বশুর স্বর্নের একটি চেন পড়িয়ে দিবে না , তা হয় নাকি ? ব^ন্ধু বান্ধব
ই বা কি বলবে।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|