ইতিহাসের ধারায় দূর্গাপূজা
শাশ্বত স্বপন
২য় পর্ব
মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দূর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব নাই। বিন্ধ্যাচলের
দক্ষিণে এই পুজো প্রচলন ছিলো কিন্ত তার আগে বা পরে রামের অযোধ্যায় রামায়নে
দুর্গাপুজোর কোন উল্লেখ নেই৷ বাল্মিকীর রামায়নে অকালবোধনই নেই৷ এমন কি,
বনবাসের আগে বা পরেও কখনও রাম অযোদ্ধায় দুর্গা পুজো করেছেন বলে কোনো
উল্লেখ নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দূর্গাপূজার অস্থিত্ব আছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক
অনুবাদ নয়। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা
সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরে তৎকালীন সমাজে
প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ,
গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে (নাকি গৌড়েশ্বর, কংস নারায়ন , অন্য কারো
অনুরোধে?) ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ
বা বাংগালীকরন করেন--যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তার সমাজের আদি কাহিনী।
তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে--যা
বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের
ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন।
শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রাম
চন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি
হিসাবে দূর্গা পূজা করে দূর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা
করেছেন। তবে দূর্গাপূজার সব চাইতে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় মার্কন্ডুয়ে
পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কন্ডুয়ের কথোপকথনের ভিত্তিতে
পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে
পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রী চন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্ম্যম
পাঠ আছে--যা দূর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী
হয়ে গেছে ।
প্রাচীন বাংঙ্গালীরা ছিল অবৈদিক আর অনার্য। তারা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু
লোকিক-অলৌলিক দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত । প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা
শস্যপূজারূপে বিরাজমান ছিল। পার্বতী-উমা ছিল শস্যপূজার দেবী। পার্বতী-উমা
দুর্গারই ভিন্ন নাম। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী
পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। এই সিংহবাহিনী
পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীর সঙ্গে শস্যপূজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি
হয়েছে, ইনিই দুর্গা।
সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দূর্গার
আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। পুরাণ মতে, সত্য যুগে বিন্ধ্যাচলের কোল
বংশীয় রাজা সুরথ ( ও সমাধি বৈশ্য) প্রথম মৃন্ময়ীমূর্তিতে শরৎকালে দুর্গা
পুজো করেন। মার্কন্ডুয়ে পুরান (Markandeya Purana ) মতে, চেদী রাজবংশের
রাজা সুরাথা(Suratha) খ্রীষ্ঠের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে
ওড়িষ্যা) Duseehera নামে দূর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। নেপালে Duseehera বা
Dashain নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন ওরিষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র
আছে কিনা বা বিন্ধ্যাচলের কোল বংশীয় রাজা সুরথ আর চেদী রাজবংশের সুরাথা একই
রাজা কিনা--সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পুরাণ মতে, দূর্গাপূজার ইতিহাস
আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের। উপমহাদেশের
পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে শিবকে দিয়ে যে হিন্দুধর্মের যাত্রা শুরু
হয়েছিল, পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় দুর্গা ও কালীকে দিয়ে সে
ধর্মযাত্রার সমাপ্ত হয়...। এরপর সম্ভবত আর কোন অলৌকিক দেবতার জন্ম হয়নি।
চলবে
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |