[প্রথমপাতা]

 

 

 

ওইখানে যেওনাকো তুমি(৯ম পর্ব)
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 

 
দুটি মেয়ে থাকলেও একটা ছেলে সন্তান থাকবে না সেটা তারা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু আপু কিছুতেই শারীরিক এই অসুস্থ্যতার মধ্যে আর একটি বাচ্চা নিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে ইদানিং তার সংসারে প্রায়ই অশান্তি লেগে থাকে। পান্না আপুর সাথে নীরা আপুর এখনো যোগাযোগ হয়। তবে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল বলে স্বামী সংসারের কোন কষ্টের কথা পান্না আপু নীরা আপুকেও বলত না। কিন্তু এখন নাকি তার স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজন জোর করছে আপুকে। হয় পুত্র দিবে তাদেরকে ,না হয় তার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে অনুমতি দিবে। পুত্র তাদের চাই ই চাই। তাই বাধ্য হয়ে পান্না আপু নীরা আপুকে এসব কথা বলেছে।
ওদের কথা শুনে সাকিরা হতভম্ব। এখনো সমাজে এমন লোক আছে ? দুটি সুস্থ্য সবল মেয়ে থাকতেও ছেলের জন্য বৌ এর জীবন বাজি রেখে সন্তান নিতে হবে ? আর একটা বাচ্চা হলেই যে সেটা ছেলে হবে সেই গ্যারান্টি কে দিবে ? আশ্চর্য এ সমাজের রীতি নীতি। এসব কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।
নীরা আপু আমাদেরকে বলছে আপনাকে সাথে নিয়ে পান্না আপুর শ্বশুরবাড়ি যেতে। সেখানে যেয়ে তাদের সাথে কথা বলতে। পরিস্থিতি বুঝে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে সাকিরা আপু।
চলো তাহলে এখনি যাই। গিয়ে দেখাচ্ছি পুত্র সন্তান কাকে বলে ? রূপা তুমি বলে দিও যে, আমার মায়ের এক পুত্র অবাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে ,আর এক পুত্র কিছুদিন পর পর ধোলাই খেয়ে খোড়া হয়ে বাড়ি ফিরে। পুত্রের শখ ? লক্ষèী লক্ষèী মেয়ে থাকতে কেন যে মানুষ পুত্র আশা করে ? ঐ এক সম্পত্তি রক্ষা,বংশ রক্ষার বাতিক। যেন মেয়েদের কে দিয়ে বংশ রক্ষা হয় না।
ওদেরকে দেখে পান্নাতো আকাশ থেকে পড়ল। সাথে সাকিরাকে দেখে তার বিষ্ময়ের শেষ নেই। নীরার কাছে এই রমনী সম্পর্কে শুনেছিল। এখন দেখা হল। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে তারা এল এই নিয়ে পান্নার মনের মধ্যে ভয় । তাহলে কি নীরাই ওদেরকে পাঠিয়েছে ? নীরা বলছিল যে আমাকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবে। কিন্তু ওদেরকে দেখলে তো এ বাড়ির লোকজন আমার উপর আরো ক্ষেপে যাবে। বলবে যে আমিই খবর দিয়ে এনেছি।
সাকিরা পান্নার কাছে সব কথা শুনতে চাইল। পান্নার শাশুড়ি প্রথমে দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিলেন। পরে সাকিরা তাকে ডেকে এনে বসালেন। পান্নার স্বামীকেও ডাকলেন। তারপর বললেন,আপনারা একেতো আগে থেকেই একাধিক অপরাধ করে বসে আছেন। তার উপর এখন যেটা করতে যাচ্ছেন তা তো গুরুতর অপরাধ ।
পান্নার স্বামী বলছে , কি করেছি আমরা ?
সাকিরা - প্রথমত পান্নার বিয়েটা ছিল এক হিসেবে বাল্য বিবাহ। বাল্য বিবাহ আইনত অপরাধ। আর যে কারনে বাল্য বিয়ে অন্যায় ,পান্নার সাথে সেটাই হয়েছে।
আঠারো বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দিলে অল্প বয়সে তারা সন্তানের মা হয়। আর ঐ বয়সে একটি মেয়ে মা হবার জন্য শারিরীক এবং মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকে না। পান্নার প্রথম সন্তানও আসে বিশ বছর বয়সের আগেই। যা তার শরীরের ভিতটাকে দুর্বল করে দিয়েছে। তারপর দু’বছর না যেতেই আর একটি সন্তান। তাও আবার গ্রাম্য ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসব। এক কথায় পান্নার উপর রীতিমত জুলুম করা হয়েছে। সেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে পান্নার শারীরিক সমস্যা হয়েছে এবং ডাক্তারেরই কথা যে, সে আর মা হতে পারবে না। তাহলে তার জীবন মৃত্যুর সম্মুখীন হবে। তো এই কথা জেনেও আপনারা তাকে তৃতীয়বার সন্তান নিতে বাধ্য করতে চাচ্ছেন ,শুধুমাত্র পুত্র সন্তানের আশায় ! কেন কন্যা সন্তান কি সন্তান না ? আপনাদের সৌভাগ্য যে দুটি সুস্থ্য সবল ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছে পান্না। এই নিয়ে গর্ব করুন না । আসলে পুত্র দিয়ে কি হয় । ঘরে ঘরে পুত্র অবাধ্য হয়ে বাবা মাকে কষ্ট দিচ্ছে। বুড়ো বয়সে পুত্রের উপর নির্ভর করে শেষ জীবনটা পার করবেন এই আশা করলে দেখা যায় যে অনেক পুত্রই বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদা সংসার করছেন। মা বাবাকে ফিরেও দেখে না। আর আজকাল তো শহরাঞ্চলে হর হামেশাই বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে সোনার পুত্ররা। সেসব খবর কি আপনাদের কাছে আসে না ? এর চেয়ে মেয়ে সন্তান ঢের ভাল । আমিতো মনে করি ঘরে ঘরে এখন মেয়ে শিশু কামনা করে প্রত্যেক পিতা মাতার মোনাজাত করা উচিৎ । মেয়েরা পরের বাড়ি গেলেও বাবা মায়ের কথা ভাবে।
পান্নার স্বামী চুপ করে থাকে । ওর শাশুড়ি বলে ,মেয়েদেরকে বিয়ে দিলে পরের বাড়ি চলে যাবে। তখনতো বংশে বাতি দেয়ার কেউ থাকবে না।
কেন মেয়েদেরকে দিয়ে কি বাতি দেয়া যায় না ? আগে এই মেয়ে দুটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেন । বিয়ে দিলে পরের বাড়ি চলে যাবে সেকথা পরে ভাবেন। আর বংশ রক্ষা বলতে কি বুঝায় ? বংশ কি রক্ষা করার দায়িত্ব বৌ এর উপর বর্তায় ? বৌ যদি অসুস্থ্যও হয় তবুও তাকে মরে গিয়েও আপনাদের বংশ রক্ষা করে যেতে হবে ?
পান্নার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন , আপনিতো পান্নাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তাই না ? তো সেই স্ত্রীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েও আপনি পুত্রের শখ মেটাতে চাচ্ছেন ? কিভাবে পারেন আপনারা ?
সাকিরার এমন সব কথায় পান্নার স্বামী এবং শাশুড়ির মুখ থেকে আর কথা বের হল না।
পান্নাতো মনে মনে ভয়ে চুপসে যায়। না জানি এর ফল কি হয় । সাকিরা চলে গেলে পান্নার উপর নেমে আসবে আরো অত্যাচার।
কিন্তু না। কাজ হল। সাকিরা থাকতেই পান্নার স্বামী বলল ,আপা আমার আর পুত্র সন্তানের শখ নাই। আল্লাহ যে মেয়ে দুটি দিয়েছেন তাদেরকেই যেন মানুষ করতে পারি এখন আমার এই ইচ্ছা। শাশুড়িও আর কোন কথা বলল না।
সেই বাড়িতে বসেই সাকিরা নীরাকে ফোনে বিস্তারিত জানাল।
রূপাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে । প্রতিদিন চারটি ক্লাস শেষ হলে ক্রিড়ানুষ্ঠানের মহড়া চলে। শীতের বেলা তাই বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । কুয়াশার দিনগুলোতে সন্ধ্যা নামার আগেই প্রকৃতিতে সন্ধ্যার আবহ বিরাজ করে। তুলি ,রূপা,পাপিয়া,øেহার মত মেয়েরা গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে।
একদিন স্কুল থেকে বের হতেই স্কুল গেটে দুটি ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপা আর তুলি। ওরা ওদের মত করে হাঁটা শুরু করে। কিন্তু পরে খেয়াল করে দেখতে পায় ছেলে দুটি যেন ওদের পিছু নিয়েছে। ওরা হাঁটলে ছেলেগুলি হাঁটে,ওরা থামলে তারাও থামে। হাঁটতে হাঁটতে ছেলে দুটি ওদের সাথে সাথে অনেক দূর পর্যন্ত চলে আসে। এক সময় একটি ছেলে একটু এগিয়ে রূপা আর তুলির বরাবর এসে রূপাকে উদ্দেশ্য করে বলে , তোমার নাম রূপা না ?
রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে । চেনা নাই জানা নাই কোথাকার কোন ছেলে এসে সরাসরি তার নাম রূপা কিনা জানতে চাচ্ছে। রূপার তাকিয়ে থাকা দেখে ছেলেটি আবার বলে ,তোমার সাথে একদিন আমার দেখা হয়েছিল একটা বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে। তোমার অবশ্য মনে পড়ার কথা না । কারন তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়নি তেমন করে। তবে আমি তোমাকে ঠিক মনে রেখেছি রূপা।
কে আপনি ? আর এভাবে আমাকে নাম ধরে তুমি করে বলছেন কেন ? আপনাকে তো আমি চিনি না। অচেনা মানুষের সাথে আমি কথা বলি না।
-ব মানুষই প্রথমে অচেনা থাকে। আর অচেনা বলেই তো পরিচিত হতে এলাম।
দেখেন এভাবে রাস্তাঘাটে মেয়েদের পিছু নিবেন না। এটা অত্যন্ত জঘণ্য এবং ঘৃনীত কাজ বলে আমি মনে করি। আমাদেরকে যেতে দিন।
রাগ করছ কেন রূপা ? আমার কথাটা একটু শোন ।
আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমাকে যুগ যুগ ধরে চেনেন,মনে হচ্ছে আপনার সাথে আমার অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক । রাস্তা ঘাটে মেয়েদেরকে উত্যক্ত করেন কেন ?
রূপা, তোমাকে আমি আমার এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। তুমি গিয়েছিলে সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে। যৌতুক নিয়ে আমার বন্ধু বিয়ে করতে চেয়েছিল বলে তোমরা ক’জন মেয়ে সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আমার বন্ধুকে লেজ গুটিয়ে বিয়ের আসর থেকে চলে আসতে বাধ্য করেছিলে। সেদিন আমিও কিন্তু পাত্র পক্ষের দলে ছিলাম বলে কিছুটা লজ্জা ,কিছুটা অপমান বোধ করছিলাম।
তুলি বলে উঠল,ওহ্ আজ কি এসেছেন সেই অপমানের শোধ তুলতে ? এটাতো আপনারা ভাল পারেন । যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবেন ,আবার সেটা কেউ বললে আপনাদের অপমান বোধ হয়। জয় হোক আপনাদের সেই বোধের।
পাশের ছেলেটি বলল,দেখেন আপনারা ভুল করছেন। আমরা কোন অপমানের শোধ নিতে আসিনি।
আগে কথা বলা ছেলেটি আবার বলা শুরু করল- সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছিল সেদিনের রূপা নামে মেয়েটি। যাকে আমি মন থেকে সরাতে পারি না কিছুতেই। তোমার মধ্যে দেখেছিলাম একটি উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা। এতটুকু একটি মেয়ে ,অথচ কি স্পষ্ট কি আর দৃঢ় ছিল তোমার কথাগুলো। আমার জীবনে মেয়েদের এতটা সাহসী , যুক্তিবাদী ,ব্যক্তিত্বশালী হতে দিখিনি কখনো। তোমার রূপের কথা বলব না রুপা। সেটা তুমি নিজেই জানো । তোমার বাহ্যিক দিকের চেয়ে তোমার চিন্তা চেতনা আর মূল্যবোধ কে আমি মুলায়ন করি।
আমাকে যেহেতু সেদিন দেখেছিলেন তো আমার সম্পর্কে সামান্যতমও ধারনা আপনার হয়েছে নিশ্চয়ই। তো সেই ধারনা যদি হয়েই থাকে আমি আশা করব আপনি এখন আপনার পথ দেখবেন। দয়া করে আমাদেরকে আর বিরক্ত করবেন না।
তোমাকে বিরক্ত করতে আসিনি আমি। একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম।
অনেক কথাই তো বলে ফেললেন । এখন আবার একটা কথা কি বলবেন ?
রূপা ,আমিকি তোমার বন্ধু হতে পারি ?
না। একদিনের পরিচয়ে কেউ কারো বন্ধু হয় না।
একবার আমাকে সুযোগ দাও,আমি নিজেকে উপস্থাপন করি তোমার কাছে। তারপর ভেব বন্ধু হতে পারি কি না। তোমার ভাবনাগুলোকে আমি শ্রদ্ধা করি,তোমাদের কাজগুলোকে মন থেকে মেনে নেই ।
দেখেন এসব কথা পুরুষরা বলে ঠিকই । কিন্তু যখন নিজের উপর এসে পড়ে তখন তারা ঐ পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে ধরা দেয় । বন্ধু টন্ধু আসলে কিছু না।
রূপা যখন ছেলেটার সাথে তর্ক করছিল রাস্তায় চলা কিছু লোক তাদেরকে দেখছিল । কেউ কেউ সামনে গিয়ে আবার ঘাড় বাঁকা করে পিছনে দেখে নিয়েছে আর একবার। রূপা বেশ বুঝতে পারছে এই ছেলেগুলিকে ওদের সাথে দেখে মানুষ মনে মনে গল্প বানাচ্ছে। তখন ছেলে দুটির উপর প্রচন্ড রাগ হল। রূপা বলল,যদি আমাদের প্রতি আপনাদের সামান্যও শ্র্দ্ধাবোধ থাকে তো দয়া করে এবার আমাদের পথ ছাড়েন। আপনাদের এভাবে কথা বলার ফলটা আমাদের জন্য খুব ভাল হবে না। আমাদের ভাল চাইলে আর সামনে না আসলে খুশি হই।
ভদ্রতা রক্ষার্তে ওরা আর আগালো না। তবে যাবার সময় বলল, আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু সৎ ছিল রূপা। আমরা তোমাদেরকে বিরক্ত করতে আসিনি। তোমাকে আমার ভাল লেগেছিল ।
সেদিন রূপা বাড়ি আসার আগেই রাস্তার খবরটা বাড়ি পৌঁছেছিল। ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন ,খুব তো মেয়েদের স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করছ, রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্তকারীকে শাস্তি দিচ্ছ । এখন সেসব লোকেরা এসে আমাকে বলে যায়,আপনার মেয়ে অন্যের বেলায় কথা বলতে আসে,আর সে যখন ছেলেদের সাথে হেসে খেলে রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করে তখন সেটা কি কিছু না ?
রূপা বলে,বাবা আমিতো কারো সাথে হেসে খেলে আসিনি। দুটি ছেলে আমাদের পথ আগলে কথা বলতে এসেছিল । এখানে আমাদের কি দোষ ? আর এমন তো নয় যে আমরা তাদের পাত্তা দিয়েছি।
তোমরা প্রশ্রয় না দিলে ছেলেরা এতদূর পর্যন্ত আসে কি করে ?
বাবা তুমিও মানুষের কথা বিশ্বাস করে তাদের মত করেই কথা বলছ ? তুমি কি আমাকে চিন না ?
চিনতে আর পারলাম কোথায় ? নিজের ছেলে দুটিকে চিনতাম বলে জানতাম। তা কি তারা সেই চেনা রূপ রাখতে পারল ? এখন মেয়েকে চিনি বলে নিশ্চিন্তে বসে থাকব , তো একদিন দেখব তাকেও আমরা চিনি না।
বাবার কথায় রূপা দু:খ পেল। আবার বাবার জন্যও দু:খ লাগল মনে।
ভাই দুটি তাদের সমস্ত আশা ভরসাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে বলে এখন কোন সন্তানের উপরই বাবা মায়ের আস্থা নেই। কিন্তু আমিতো তাদের মত নই। তাহলে আমাকে এসব কথা কেন শুনান তারা ?
স্কুলের ক্রীড়ানুষ্ঠানে রূপাদের স্কুলে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার আসে। সেই জোয়ার হল মানুষের জোয়ার। দর্শকের জোয়ার। অন্য কোনদিন এই স্কুলের গেট জনসাধারনের জন্য খোলা হয় না। কিন্তু এই দিনে তা সবার জন্য উম্মুক্ত থাকে বলে পিঁপড়ের মত পিল পিল করে শত শত মানুষ কোথা থেকে যে এসে জড়ো হয় । এরও একটা কারন আছে । আসলে এই স্কুলের মেয়েদেরকে সবাই রাস্তায় যেতে আসতে দেখে। ক্রীড়ানুষ্ঠানে মেয়েদের দৌঁড়,ঝাপ দেখার জন্য তাই সমাজের সর্ব শ্রেনীর পুরুষ দর্শকের উপচে পড়া ঢেউ এসে স্কুলের উপর আচড়ে পড়ে। তারপর বিকেল বেলা থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তখন বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়েও দর্শকের চাপ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। যে মেয়েরা মাথা নিচু করে চুপচাপ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তাদরেকে নাচতে গাইতে দেখতে পুরুষদের কৌতুহলের শেষ নেই। দেখে তারা মজা পায় । মেয়েরা তো মজা দেবারই একটা বস্তু আসলে।
এসএসসি পরীক্ষা শেষে ওরা কিছুদিন সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যেখানেই নারীর উপর কোন অন্যায় অত্যাচারের কথা শুনে সেখানেই ছুটে যায় তারা। কোন বাড়িতে বৌকে পিটানো হল,কোন বাড়িতে মেয়ে শিশুকে স্কুলে যেতে দিচ্ছে না, রাস্তা মেরামতের কাজে নারীদের পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি দেয়া হয় ,কোথায় যৌতুকের রমরমা আয়োজন নিয়ে নারী পুরুষের বিয়ের অনুষ্ঠান চলে , কোন বাড়িতে প্রেমিকের প্রত্যাখান সইতে না পেরে অবোধ বালিকা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে –এসব জায়গায় ছুটোছুটি করে ওদের দিন কাটে। এর মধ্যে রূপা শেষ করে দেশ বিদেশের নানা বই। সাহিত্য তার ভীষন পছন্দ।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। দু’জনই ভাল ফল করে। কলেজে ভর্তি হয়ে সবকিছু অন্যরকম লাগে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পদার্পন করে নিজেদেরকে বালিকা থেকে তরুনী বলে মনে হয় । এতদিন বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত বলে তেমন কোন ছেলেদের সাথে তাদের আলাপ ছিল না। এখন একই সাথে ছেলে মেয়ে পড়ছে। কারো কারো সাথে কথা হচ্ছে। তবে রূপা কখনোই ছেলেদেরকে পাত্তা দেয় না। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সে অহংকারী মেয়ে হিসেবে কলেজে নাম লিখিয়েছে। ছেলেদের সাথে হেলে দুলে কথা না বললেই সেই মেয়ে অহংকারী বলে বিবেচিত হয়। সিনিয়র ভাইয়েরা আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসে। কেউ আসে রাজনীতির খাতায় নাম লিখাতে। নানা ধরনের ভেলকিবাজি দেখে রূপার বিষ্ময়ের শেষ নেই।
অনেক দিন পর রূপা আর তুলির কাছে নীরার এক দীর্ঘ চিঠি আসে । নীরার নতুন চাকরী নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্ননা করেছে। এই পেশায় মেয়েদেরকে দেখে সাধারন মানুষ কি ভাবছে,সহকর্মীরা কিভাবে নিচ্ছে,কতটা পরিশ্রম করতে হচ্ছে । সবকিছু লেখা আছে চিঠিতে।
নীরা বেশ উপভোগ করছে চাকরীটা। সবাই যেন প্রথমে একটু বিষ্মিত হচ্ছে , কেউ একটু বেশি শ্রদ্ধা করছে , কেউ করছে ভয় । তবে ভয় আর শ্রদ্ধাটা তারা নারীকে করছে না। করছে ঐ বড় পদ মর্যাদাকে। সেই পদে যেই থাকবে তাকেই শ্রদ্ধা করতে হবে। শ্রদ্ধাটা যেন ব্যক্তিকে নয়, ব্যক্তির পদ টাকে। নীরা চায় মানুষ মানুষকে শ্রদ্ধা করুক,কোন ক্ষমতাকে না। কিন্তু সমাজে তাকেই মানুষ শ্রদ্ধা করে; যার আছে অর্থ,বিত্ত ,প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা। এখানে মনুষ্যত্ব যেন কিছুই নয়।
চিঠিতে রূপা আর তুলির পরীক্ষা বিষয়ক নানান উপদেশ দেয়া আছে। ভাল ফলাফলই নির্ভর করবে তাদের ঢাকাতে যেয়ে পড়াশুনা। এখন থেকেই সেই চেষ্টা করতে হবে।
দেখতে দেখতেই একটা বছর কেটে গেছে। ফাইনাল পরীক্ষা খুব বেশি দূরে নয়। ওরা ঢাকাতে সুযোগ পেলে হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দিবে নীরা। তারপর নীরা যখন বদলী হয়ে ঢাকা আসবে তখন তারা তিনজন এক সাথে থাকবে ।
কিছু দিন হল সাকিরা এখান থেকে বদলী হয়ে চলে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে ওদের মাথার উপরের ছায়াগুলো কমে আসছে। নীরা আপু যাবার পর সাকিরা আপা ওদের যেকোন কাজে পাশে থেকেছে। সব রকমের সহায়তা সে করেছে। কাজপ্রিয় মানুষ সাকিরার কাছে কাজের জন্য কোন আন্তরিকতার অভাব ছিল না। সংসার কর্ম ছিল না বলে যখন তখন ছুটে গেছে কাজের সন্ধানে। যাবার সময় খুব মন খারাপ ছিল সাকিরার। জীবনে যত জায়গায় চাকরী করেছে এ অঞ্চলের কথা তার মনে জ্বল জ্বল করতে থাকবে। বিশেষ করে এখানের এই মেয়েগুলিকে সে ভুলতে পারবে না কিছুতেই। গ্রামের এই মেয়েগুলি যেভাবে সমাজের নানা অনাচার থেকে নারীদেরকে রক্ষার কথা ভাবছে, তা শহরের অনেক শিক্ষিতরাও ভাবে না কখনো।
কিছুদিন থেকেই তুলি কেমন মন মরা হয়ে বসে থাকছে। প্রায়ই কলেজে যায় না। জানতে চাইলে বলে শরীর খারাপ। পড়াশুনা ঠিক মত করছে না বলে মনে হয়। টেস্ট পরীক্ষায়ও তার রেজাল্ট মোটেই ভাল হয়নি। রূপা জিজ্ঞাসা করলে বলে,না কিছু হয়নি তো। কোন কাজে তুলির কোন উৎসাহ নেই। আগে যেসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত এখন সেসব কোন আমলেই নেয় না সে। রূপা পড়াশুনা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত দিন পার করছে। এরই মধ্যে তুলিকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল কিছু হয়েছে কি না। তুলি বরাবরই বলে আসছে ,কিছু হয়নি।
পরীক্ষাটা ভালয় ভালয় শেষ হল। রূপা আশাবাদি যে সে অবশ্যই ভাল ফল করবে। সুযোগ পেলেই রূপা তুলির সাথে ঢাকার কথা আলোচনা করে। কিভাবে যেতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেতে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে ,কোথায় থাকবে- এমন হাজারো কথা। কিন্তু ইদানীং তুলিকে কেমন অন্যরকম লাগে রূপার কাছে। কেমন মন ভোলা ভাব। এসব প্রসঙ্গ তুলিকে ঠিক নাড়া দেয় না। কথা বললে যেন শুনতে পায় না এমন । সারাক্ষণ নিজের মনেই কি ভাবতে থাকে। প্রায়ই রূপা জানতে চায় তুলি এত কি ভাবছিস মন মরা হয়ে ? তুলি কোন উত্তর দেয় না।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ