সিডনির মেলব্যাগ
॥ ক্ষমা যেথা ক্ষীণ
অজয় দাশ গুপ্ত
কত কারণে যে মন খারাপ হয় আমাদের। সবচেয়ে বড় জায়গাটা জুড়ে আছে
রাজনীতি। প্রবাসেও কেউ এর বাইরে যেতে পারছি না। সম্প্রতি শহীদ
মিনার নিয়ে শহীদ মিনার বিরোধীদের অপরাজনীতি দেখলাম। গোড়াতে বলে
রাখি কোন মৃত্যুই আনন্দের নয়। বিশেষত যে কোন মানুষের হঠাৎ চলে
যাওয়া কখনও উল্লাসের কিছু হতে পারে না। উপমহাদেশের শিক্ষা,
সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনাচারণ বলে জীবনই হচ্ছে আনন্দের উৎস। সে কারণে
গিজ গিজ করা মানুষের সমাজে এখনও শিশুর জন্ম আনন্দময় এক উৎসব। এই
যে জীবনবোধ ও ভাল লাগা এর মর্মমূলে আঘাত করা মানুষের বিদায়
আনন্দিত না করলেও শোকার্ত করে না। বরং তারা যে ক্ষত ও বিতর্ক জাগিয়ে
রেখে যান তাকে ঘিরে আবর্তিত বাঙালীদের দেখে ভয় পাই। বিগত এক
সপ্তাহ শহীদ মিনার নিয়ে টান টান উত্তেজনা আর দালালদের গলাবাজিতে
মনে হচ্ছিল সংঘাত বুঝি অনিবার্য! একটা বিষয় অমার মতো সাধারণ
মানুষের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। আমি যদি ধার্মিক তো ধার্মিকই
সেটাই হবে আমার একমাত্র পরিচয়। আর যদি সংশয়বাদী হই তো তা নিয়ে
জাহির করারও কিছু নেই। আমাদের পূর্বপুরুষরা বোকা কিছু ছিলেন না।
উপমহাদেশের সন্তান বুদ্ধকে অতিক্রম করার মতো দার্শনিক জন্মায়নি
এখনও। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন বসু কাজী নজরুল, জগদীশ বসু, সুফি
মোতাহের হোসেন এখনও অনাদি, অম্লান। তাঁদের মতো
কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক বিজ্ঞানী থাকার পরও আমাদের কূটতর্ক থামে
না। নতুন কিছু যোগ করতে ব্যর্থ মানুষ ধর্মের নামে যেমন উন্মাদ তেমনি
ধর্ম বিরোধিতায়। এই ধরনের বিকৃতিবোধে আক্রান্তরা এসব কর্মকা-ে
নিজেদের পপুলারিটি বাড়াতে গিয়ে জাতিকে মহাবিভ্রান্তিতে ফেলে
দিচ্ছেন। প্রকৃত ধার্মিকের জীবন আল্লাহ ও ঈশ্বর অনুগত; আমাদের পিতা
মাতাদের বেলায় তাই দেখেছি আমরা। তাঁরা প্রার্থনার বাইরে সংসার ও
মানুষের কল্যাণ ব্যতীত আর কিছু চিন্তা করতেন না। তাঁদেরও রাষ্ট্র
ভাবনা, সমাজ নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে দুর্ভাবনা কখনও রোগ বা
উপসর্গের মতো সর্বজনে বিলায়নি তাঁরা। আগের দিনেও ধর্ম নিয়ে
রাজনীতি ছিল। ভারত বিভাগ বা সাম্প্রদায়িকতাই তার বড় প্রমাণ।
কিন্তু তার দায়ভার ছিল রাজনীতিবিদদের। তাঁদেরই মানুষ হিরো বানাত
প্রয়োজনে জিরোতে নামিয়ে আনত। কথায় বলে যার কাজ তারে সাজে। যে
জায়গাটা এখন আমূল পাল্টে গেছে। আমি বলব আমরা এবং মিডিয়াই তা
পাল্টিয়ে দিয়েছি। সময় পূরণ আর টিভি বা অন্য মিডিয়া বাঁচিয়ে
রাখার স্বার্থে চালু টকশো এখন এক ধরনের উপদ্রব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রয়াতজন ছিলেন সে ঘরানার কথিত এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। কথিত
বললাম এই কারণে, কোন জনপ্রিয় ব্যক্তি তাঁর দেশ ও সমাজের মৌল বিষয়ে
বিতর্ক করেন না। উদার গণতান্ত্রিক আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার কথাই ধরি
না কেন। বাকস্বাধীনতা বাকস্ফুর্তি আর রাজনীতি বিষয়ে খোলামেলা
ব্যঙ্গ বা কৌতুক এখানে জলভাত। এমন সব কার্টুন দেখি পিলে চমকে ওঠে।
জাতীয় পতাকাকে চপ্পলে এঁকে স্যান্ডেলের মডেল বানিয়ে ঘুরে
বেড়ানোর এদেশেও কিন্তু রাজনীতি বা রাষ্ট্র নিয়ে দেশদ্রোহিতা চলে
না। ইদানীং আইএসয়ের জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়া অজিদের নিয়ে
উদ্বিগ্নতা শীর্ষে। এখানে জন্ম নেয়া অথবা বড় হয়ে ওঠা তারুণ্যের
এক ক্ষুদ্র অংশ পথহারা। তারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কথিত জিহাদের নামে
লড়াই করতেও পিছপা নয়। এদের নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের
দুশ্চিন্তাজনিত টিভি শোগুলো এখন বিপুল জনপ্রিয়। সেখানে দেখলাম এমন
এক উগ্র তরুণ ও তার আইনজীবীদের আস্ফালন। দেখে মনে হচ্ছিল এও কি
সম্ভব? এত টলারেন্স বা সহ্য ক্ষমতা কি কোন দেশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক
রাখতে পারে? খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। দু’দিন পর দেখি ঐ
যুবক শ্রীঘরে। দেশ ও জাতীয় ঐক্য বা স্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলে পার
পাওয়া যে কোন সভ্য দেশেই অসম্ভব। শুধু আমরাই ছাড় দিচ্ছি। এই ছাড়
দেয়ার ফাঁক ফোকর গলে বেড়ে ওঠা টকশোপ্রবণ মানুষরা এখন শহীদ মিনার
নিয়েও নিজেদের বিবাদ ও কাইজা জাতির ঘাড়ে তুলে দিতে চাইছে। এমন
বাংলাদেশ কি আসলে কোন দিনও আধুনিক হতে পারবে? যিনি গেলেন, তার
পিতার কারণেই পাক বাহিনীর হাতে নাজেহাল হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। অপরাধ জাতীয় সংসদে বাংলার হয়ে প্রথম
ওকালতি। সে পিতার সন্তান সুশিক্ষিত একদা প্রবাসী আধুনিক বা
বৃদ্ধিমান হওয়ার পরও পিতার দায় ঘোচাতে পারেননি। উল্টো এই হতভাগ্য
জাতির কথিত শিক্ষিতদের আরও অন্ধ আরও উগ্র করার কাজটিই করে গেছেন।
একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। যারা শহীদ মিনারকে বেদী মনে করে
পুষ্পস্তবকে পুজোর অর্ঘ ভাবে, যাদের জীবনে বাংলাদেশের পরিবর্তে
বাংলাস্তান বড়, তারা কেন মৃত্যুর পর জাতীয় প্রতীক ও মর্যাদার
অংশীদার হতে চায়? এর মানে কি এই যে এরা আসলে এগুলোর মূল্য জানে,
বোঝে এবং কায়মনোবাক্যে তা চায়? নিজের ব্যর্থতা, অন্ধত্ব আর
প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে সারা জীবন উল্টো পথ বেয়ে চলেন? নাকি এর
পেছনে থাকা কথিত স্বর্গ নরক আর প্রলোভন?
যেটাই থাকুক আজ সময় এসেছে পরিষ্কার অবস্থানের। নইলে এ জাতি
কোনদিনও মাথা তুলতে পারবে না। কঠোর ও কঠিন হও বাঙালী এখনই সময়।
|