[প্রথমপাতা]
|
ওইখানে যেওনাকো তুমি(১২ পর্ব)
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
সপ্তাহের একটি শুক্রবার রেহানা হোস্টেলে থাকে। সেদিন তার রাজ্যের কাজ। এক
দুপুর কাজ করে খেয়ে দেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেয়। উঠতে উঠতে সন্ধ্যা । তারপর
বাইরে যেয়ে ঘুরে ফিরে আসে। সেদিন তার বেড়ানোর দিন। ঢাকা শহরে যত আত্মীয়
স্বজন আছে তাদের সবার সাথে একদিন একদিন করে দেখা করে। ওই সন্ধ্যাটা সে এই
কাজ করে। তারপর যত রাতই হোক নিজের ঘরে ফিরে আসে।
এ ক’দিন রূপা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রেহানা তেমন একটা কথা টথা বলত না
ওর সাথে। আজ অফিস থেকে ফিরে এসেই বলল চলো রূপা আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব, খাব।
তারপর তোমার সাথে গল্প করব সারারাত। থাকতে পারবে তো আমার সাথে ?
হ্যা আপু ,পারব।
তাহলে চল এখনি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু আপনি মাত্র এলেন অফিস থেকে । এখনি যাবেন ?
হ্যা চলো, আমার কোন অসুবিধা নাই। তুমি এসে যে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজলে আর
মাথা তুলে দেখলে না। এই বিচিত্র শহরটাকে যদি নাই চিনলে তো থাকবে কিভাবে ?
প্রথমে বের হয়েই রেহানা রূপাকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে গরম
গরম পিয়াজো আর চা খেল। এভাবে খাওয়ার মধ্যে অন্যরকম একটা মজা পেল রূপা।
গ্রামে হলে কিছুতেই দুটি মেয়ে এমন করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে পারত না।
এখানে কেউ কিছু মনে করে না। বরং ভালই লাগছে। ধোঁয়া উঠা কেতলি থেকে লিকার চা
ঢেলে দোকানী কাপে দুধ আর চিনি দিয়ে চামচ দিয়ে নেড়ে দিল। চায়ের স্বাদটা
খারাপ লাগেনি।
চা খেয়ে ওরা হাঁটতে থাকল। দু’জনের মুখে ছোট ছোট কথা।
রেহানা বলছে, রূপা তুমি তো দেখতে অনেক সুন্দর। সুন্দর মেয়েদের অনেক চাহিদা
থাকে সব জায়গায়। সুন্দর বলে তারা জীবনে কিছু বিশেষ সুবিধাও পেয়ে যায় । আবার
সুন্দর হওয়াতে অনেক গঞ্জনাও সইতে হয়। সুন্দরী মেয়েরা নানান ধরনের ফাঁদে পড়ে
যায় ।
সুন্দরদের কি সুবিধা আপু ? আমি তো মনে করি মানুষের কাজ দেখে তার যোগ্যতা
বিচার করা উচিৎ। রূপ দেখে নয়।
এটা ছেলেদের বেলায় হত। কিন্তু মেয়েদের বেলায় সুন্দর হলে এক্সটা কিছু মেলে।
এখন অবশ্য ছেলে মেয়ে কারোই যোগ্যতা দেখে কোথাও কিছু হয় না। উপর ওয়ালার সাথে
যার যত ঘনিষ্ঠতা থাকবে সেই তত উপরে উঠবে। আর উপরওয়ালারা মেয়েদের
সৌন্দর্যটাকেই প্রধান গুন বলে মনে করে। এই আমাকেই দেখ না , একই পোস্টে আছি
আজ ছয় বছর ধরে। অথচ আমার তিন বছর পরে চাকরীতে যোগদান করে একটি মেয়ে আজ আমার
বস্ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র সে সুন্দরী বলে। তার সাথে উপরওয়ালাকে খুশি করার মত
তার রয়েছে অসীম ক্ষমতা। যা আমার কোনদিনই ছিল না। না আছে আমার রূপ ,না আছে
তেল।
তেল মানে কি আপু ?
আরে তেল বুঝ না ? তোমার যত তেল থাকবে, ততই তো তুমি অন্যকে তেল দিতে পারবে।
আর তেল দিলেই তো তোমার পদোন্নতি। তবে ঐ রূপটা থাকলে তেলের বেশি প্রয়োজন হয়
না। রূপটাই তেল হয়ে কাজ করে।
একটা জায়গায় রাস্তার পাশেই বসে পড়ল রেহানা। আশে পাশে তাকিয়ে রূপা দেখে
এখানে অনেকেই পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করছে। তবে তার বেশির ভাগই জোড়া কবুতরের
মত। একটা ছেলে একটা মেয়ে। এসব দেখে রূপার কাছে অবাক লাগে। এমন খোলা জায়গায়
ছেলে মেয়েগুলি কত সহজ ভাবে একজনের সাথে আর একজন মিশছে। যেন কোনকিছুর পরোয়া
নেই। রূপার কাছে তাদের প্রত্যেক কে প্রেমিক প্রেমিকা বলে মনে হল। কারন
একমাত্র তেমন সম্পর্ক না থাকলে এত ঘনিষ্ট হয়ে বসা বা কথা বলা যায় না।
কিন্তু এ শহরে প্রেম এত খোলামেলা ! এদের পরিবার কি দেখে না এসব ? ওদেরকে
দেখে রূপার নিজেরই কেমন লজ্জা লাগছে।
রেহানা বলল,এদেরকে দেখে অবাক লাগছে তাই না ? প্রথম প্রথম আমারো লাগত। আমিও
তোমার মত করে ওদেরকে দেখতাম। ভাবতাম ওদের কি পরিবার পরিজন নেই ? বাবা মা
কষ্ট করে পড়াশুনা করতে ছেলে মেয়েদের ঢাকা পাঠায় । আর তারা এখানে ভর্তি হওয়া
পর্যšই— লাফ ঝাঁপ দেয়। তারপর ক্লাস শুরু হতেই বন্ধু জুটে যায়। পড়াশুনার
মানেটাই যায় পাল্টে। তখন দিনরাত কেবল আড্ডা আর আড্ডা। বন্ধুরা হয়ে যায়
প্রেমিক। যতক্ষণ বাইরে থাকে লতার মত জড়িয়ে থাকে। ঘরে গেলেও মুঠোফোন আর
ইন্টারনেটের বদৌলতে হাতের নাগালেই থাকে তারা।
আমিও ওদেরকে দেখে লজ্জা পেতাম। এক সময় সেই আমিও এসে ওদের পাশেই বসলাম। ওদের
মত করেই আর একজনের হাতের মধ্যে নিজের হাতটি ঢুকিয়ে অন্ধকারে বসে থাকতাম।
আমারো মন বসত না ঘরে,এমনকি পড়াশুনায়। বাবার দেয়া টাকা দিয়ে পড়াশুনা, থাকা
খাওয়া চলত; ,কিন্তু প্রেম করা চলত না। আমার আবার অহংকার বোধ বেশি ছিল। কত
মেয়েকে দেখতাম প্রেমিককে ফতুর করে দিচ্ছে। আমি করতাম ঠিক উল্টো। প্রেম করব
ঠিকই, কিন্তু তার কিনে দেয়া পাঁচ টাকার বাদামও আমি খেতাম না। কিন্তু ডেটিং
করতে গেলে টাকা পয়সাতো কিছু খরচ হতই। আর সেটা করতে যেয়ে পড়াশুনা অবস্থাতেই
চাকরী নিলাম। প্রথমে পার্ট টাইম। পরে ফুল টাইম। মোবাইল কিনে প্রতিদিন
ফ্লেক্সির দোকানে যাই। টাকা রিচার্জ করে রাতভর প্রেমিকের সাথে গল্প করি। কত
সুখের দিন ছিল আমার।
তারপর আপু ?
আমার ব্যক্তিগত কথা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে না তো ?
আরে নাহ । আমার তো ভাল লাগছে। আপনি বলেন আপু।
চাকরী যে করতাম তা প্রথমে বাড়িতে জানাইনি। তারা শুনে রাগ করবেন তাই।
মা¯টার্স পরীক্ষা পর্যন্ত বিষয়টা গোপন রেখেছিলাম। পরীক্ষাটা দিয়েই বললাম যে
আমি একটা চাকরী পেয়েছি ।
রূপা রেহানার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে। চোখে তার অনেক জিজ্ঞাসা ।
রেহানা সেটা বুঝতে পেরে বলল, তুমি এখন কিছু ভাবছ তাই না ?
তেমন কিছু না আপু । ভাবছি যে আপনি তাহলে এখন একা কেন ?
আমি জানতাম তুমি সেটাই ভাবছ । একা কি আর সাধে আছি ? বলতে যখন নিয়েছি তখন
সবই বলব।
মনিরের সাথে আমার তিন বছর আঠালো সম্পর্ক থাকে। মনিরকে আমি প্রায়ই জিজ্ঞাসা
করতাম,তুমি আমার কি দেখে পছন্দ কর ? আমার তো সেরকম সৌন্দর্য নাই। অত
মেধাবীও আমি নই। সবকিছুতেই আমি মধ্যম।
মনির বলত, তুমি মধ্যম বলেই তোমাকে আমার ভাল লাগে। আমি তোমার অন্তরটা
দেখেছি। তোমার ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। তোমার অহংবোধ আমাকে আকর্ষণ করে।
আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার আগেই মনির একটা ব্যাংকে চাকরী পেয়ে যায়। কথা
ছিল আমার পরীক্ষার পর দু’পরিবারকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাব। পরীক্ষা শেষ
করে আমিও ফুল টাইম চাকরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মনিরের সাথে সপ্তাহে দু তিন
দিনের বেশি দেখা হয় না। তাও দশ পনের মিনিটের জন্য। ওকে ফোনে সব সময় পাওয়া
যেত না। ব্যাংকে ওমন সব সময় কথা বলার সুযোগ থাকত না। সপ্তাহের ছুটির দিনে
আমরা দেখা করতাম। বাইরে যেতাম। একটা সময় দেখা,কথা বলা সবই কমে আসল। আমি
তাকে খুব মিস করতে থাকি। মনির কে এখন বিয়ের কথা বলি। সে বলে আর কিছুদিন সময়
দাও। একটু গুছিয়ে নেই। ওদিকে বাড়ি থেকে আমার বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি শুরু হয়ে
গেছে।
মাস্টার্স পরীক্ষা পর্যন্ত মেয়েরা অবিবাহিত থাকবে এটা এখনো গ্রাম গঞ্জে
প্রচলন হয়নি।
আমি মনিরকে বিষয়টা বুঝাতে চাইলাম। সে শুধু সময় নেয়। সব সময়ই ব্যস্ততার কথা
শুনায়। আমাকে বলে, ছুটির দিন বসে তোমার সাথে এ বিষয়ে কথা বলব। আমি ছুটির
দিনের অপেক্ষায় থাকি। এক একটা ছুটির দিন তার বিশেষ প্রোগ্রাম থাকে। সে আর
আসতে পারে না। আমি তখন আর খুব একটা ঘরের বাইরে যাই না। সারা সপ্তাহ অফিস
করে ছুটির দিনটা ঘুমাই। আর যে কারনে বাইরে যেতাম সেই মনির ই তো এখন থাকে
না। তো একা আমি কোথায় যাব ,কি করব।
একদিন এক শুক্রবার আমি নিউ মার্কেট যাই। হঠাৎ করে সেখানে মনির কে দেখি। না
,সে আমাকে দেখেনি। আমি তাকে দূর থেকে দেখার পর একটু আড়াল হয়ে তার পিছু নেই।
সেদিন আমার চোখের সামনে আমার সমস্ত বিশ্বাসের মৃত্যু হতে দেখি। মনিরের সাথে
একটি মেয়ে । দেখে মনে হয় নতুন বিয়ে হয়েছে এমন। কেমন আহ্লাদে ভাবখানা। অনেক
শপিং ব্যাগ মনিরের হাত ভর্তি। মেয়েটা ওর হাতের মধ্যে একটা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে চুড়ি দেখছে। মেয়েটা যে ওর বিয়ে করা বৌ এতে আমার আর কোন
সন্দেহ থাকে না। তারপরেও নিজের মনটাকে মানাতে পারছিলাম না। কেন জানি মনটা
অবাধ্য হয়ে উঠল। যাচাই করতে ইচ্ছা করল। আমি চুড়ি দেখার ভান করে মনিরের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,আরে তুমি এখানে ? কি আশ্চর্য !
আমাকে দেখে মনিরের কি যে চেহারা হয়েছে তা যদি তুমি দেখতে। পারলে মাটিটা
ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মেয়েটা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তার
স্বামীকে এমন তুমি করে বলায় সেও অবাক।
মনিরের কথা গুলিয়ে গেল মুখের ভেতর। বলে,এই তো একটু আসলাম। আমাকে বলে ,কেমন
আছেন । আমি ওদের কে আরো বেকায়দায় ফেলার জন্য বললাম,কি ব্যাপার তুমি আমাকে
আপনি করে বলছ ? আমার ভেতরে তখন কি তুফান চলছে তা শুধু আমি জানি । ইচ্ছা
করছিল ওখানেই মনিরের কলার ধরে জিজ্ঞাসা করি,কেন আমার সাথে প্রতারনা করলে ?
কিন্তু সেটা পারিনি। তাই বুঝি মনের ঝাল ঝাড়তে ওভাবে কথা বলছিলাম আমি।
মনিরের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করছে, ইনি কে মনির ?
তোতলানো মুখে মনির বৌ এর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে আমরা
বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাথে পড়তাম। আর ওর বৌ কে দেখিয়ে আমাকে বলে ,ও রিনি ।
আমার বৌ। শেষের কথাটা বলতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বলেই রিনিকে বলে,চলো
তোমার যেন আর কি কেনার আছে ? যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। আমি বোকার মত
সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তার সহপাঠী ছিলাম ? হায়রে প্রেম ! এতটা বছর
কাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন বুনেছিলাম !
অনেকক্ষণ পর রূপা কথা বলল,
আপু সে আপনার সাথে এমন করল কেন ?
তাতো আমি জানি না রূপা। তারপর আমি আর কোনদিন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা
করিনি। সেদিনের একদিন পর মনির আমাকে ফোন করে। আমি আর রিসিভ করিনি। আমার
প্রচন্ড ঘৃনা হয় তার উপর। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে ,মনির আমাকে বিয়ে
করেনি আমি দেখতে সুন্দর না তাই। ওর বৌ টা অসম্ভব রূপসী যাকে বলে। সে হিসেব
নিকেশ করে দেখেছে যে আমাকে নিয়ে রাস্তার পাশে অল্প আলোতে বসে প্রেম করা যায়
। কিন্তু পরিস্কার আলোতে আমাকে নেয়া যায় না। সাথে নিয়ে হাাঁটার জন্য পাশে
একটা সুন্দরী বৌ থাকা দরকার। তাতে পুরুষের মান বাড়ে। আমার তো ঐ রূপ ছাড়া
অন্য কিছুর কমতি দেখিনি। তাহলে সে কেন আমার সাথে এমন করল ?
তারপর আপু ?
তারপর আমি আমার মনটাকে শক্ত করে টিকে রইলাম। একজন প্রতারককে যতটা পারি ভুলে
থাকতে চাই। এমন সময় আমাকে জরুরী খবর দিয়ে বাড়ি যেতে বলল। গিয়ে দেখি আমার
বিয়ের আলোচনা চলছে। আমি বাবা মাকে বললাম , আমাকে দেখে কোন পুরুষের পছন্দ
হবে না। তো আমি বিয়ে শাদি করব না। আব্বা বললেন, তারা একজন শিক্ষিত
চাকরীজীবি বৌ চায়। সুন্দরী তাদের দরকার নেই। আমি আগেই বলেছি যে আমার মেয়ে
কালো। ছেলের বাবা বলছে ,কালো হলে কোন সমস্যা নেই। লক্ষèী একটা বৌ হলেই হবে।
তারা আমার চাকরী দেখে বিয়ে করবে। আমাকে দেখে নয়। আমি উপার্জন করব সেটাই
মুখ্য।
পুরুষ তো আসলে স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝে না। মনির আমাকে বিয়ে করেনি কারন
সেখানে তার সুন্দরী বৌ দরকার ছিল। সেটাই তার স্বার্থ। আর এই পুরুষ আমাকে
বিয়ে করবে কারন আমার মাস গেলে একটা চেক আসবে হাতে। তার কাছে আমার চেয়ে আমার
চেকের মুল্যটাই বড়। এটাও তার স্বার্থ। তাহলে আমার স্বার্থটা কোথায় ? নারীর
কি স্বার্থ আছে বিয়েতে ? না নারীর বিয়েতে কোন স্বার্থই নেই। তারপরেও নারীকে
বিয়ে করতে হয় অন্যের স্বার্থ রক্ষা করতে।
নিজের দু:সময়টাকে ঘুচাতে বাবা মার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ধুমধাম করে বিয়ে
হল। ঢাকাতে আমি তখন স্বামীর সাথে থাকছি। দু’জনই সকালে ঘর থেকে বের হয়ে
পড়ি,ফিরে আসি রাতের বেলায়। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে সংসারের উপর ঝাঁপিয়ে
পড়ি। ক্লান্ত অবসাদে আমার যেটুকু ছিল সেটুকু রূপ লাবন্যও যেন উধাউ হয়ে গেল।
আমার চেহারার দিকে আমারি তাকাতে ইচ্ছা করত না। স্বামী তাকাবে কি করে ?
রাতের বেলা ঐ একটু তাকে কাছে পাই। আমি সবকিছু দিয়ে আপ্রান তাকে সুখি করার
চেষ্টা করি। মনিরের স্মৃতি ঘষে মেজে মুছে ফেলতে চেষ্টা করি। ঘর
সংসার,আত্মীয় স্বজন চাকরী সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করি। মাস শেষে বেতনটা
এনে স্বামীর হাতে তুলে দেই। ওটি দেখেই তো সে আমাকে বিয়ে করল। তো সেটা না
দিয়ে কি আমার উপায় আছে ? সে হাসি মুখে সেদিন আমার সাথে কথা বলে ,মজা করে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হত,এ আমি কিসের সংসার করছি ! যার সাথে থাকছি সে আমার কে
? তাকে তো সেরকম আমার নিজের বলে মনে হয় না ? কেমন সমঝোতা আর শর্তমূলক
সম্পর্কের মত লাগে। আনন্দও নাই,আবেগ ও নাই ভালোবাসাও নাই। কেমন পানসে জীবন।
যন্ত্রের মত। ওনার মত উনি জীবন যাপন করছে। আমার সাথে তার কোন শখ্যতা দেখতে
পাই না। কোথাও যায় না আমাকে নিয়ে,ঠিকমত কথা বলে না। কাজের কথা ছাড়া তেমন
আলাপ নেই আমাদের মধ্যে।
কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে সে আমাকে ছাড়াই চলে যায় । আমার খুব ইচ্ছা করত তার
সাথে যাই। একদিন বললাম,তোমার সাথে আমাকে নেও না। সে বলে সেখানে তোমার যেয়ে
কাজ নাই। তুমি অন্যদের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না। কথাটা শুনে আমার
কেমন কষ্ট হল।
বিয়ের পর সেবার ই প্রথম ঈদ আমার। একদিন মার্কেটে গেলাম । সেই প্রথম সে
আমাকে নিয়ে বাইরে যায়। এর আগে আমিই একা একা কেনাকাটা করতাম। তো বাড়ির সবার
জন্য কাপড় চোপড় কেনা হল। আমার জন্য যখন কেনার পালা আমি যেটাই পছন্দ করি সে
বলে এটা না ,অন্যটা দেখ। বারবার বলার পর আমি বললাম,কি ব্যাপার তুমি এমন করছ
কেন ?
সে তখন দোকানে বসেই আমাকে বলে,আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছ ? তোমাকে যে সব
শাড়ি মানায় না সেটা জানো না ? হয়েছ তো পাতিলের তলার মত,তার উপর এই বয়সে
পছন্দ কর খুকিদের শাড়ি।
কথাটা শুনে আমার সারা গায়ে আগুনের মত বয়ে যাচ্ছিল কিছু একটা। মাথাটা ভনভন
করতে থাকল। দোকানদাররা আমাদের দুজনকে কেমন করে দেখছিল। আমি চট করে সেখান
থেকে উঠে সোজা ট্যাক্সি করে বাসায় চলে এলাম। ওর কথাগুলো আমার পিছু ছাড়ল না।
বাসায় ঢুকে আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। আমিকি এতই কুৎসিত ? আমাকে
কি সব কিছুতে মানায় না ? আমি কি বুড়িয়ে গেছি ? আমার যা ভাল লাগবে তা আমি
পড়তে পারব না ? ওর চোখে আমি এরকম ? আমার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসাতো তার
নাই ই। তার উপর বৌ এর সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে তাও তার জানা নাই। তার কাছে
আমার টাকাটাই প্রধান ছিল ? এই মানুষটির সাথে জিন্দেগী ভর একই ছাদের নিচে
আমি কি করে থাকব ?
তোমাকে তো বলেছিলাম আমার অহংবোধটা একটু বেশি। আমি কোন কিছুর সাথে নিজেকে
আপোস করতে পারি না। আমাকে বলা তার কথাটার মধ্যে আমি প্রচ›ড রকমের একটা
অবজ্ঞা অনুভব করছিলাম। আমাকে সে স্ত্রী মনেই করে না। তাই তো কোথাও নিয়ে যায়
না। আমি সাথে গেলে তার সম্মান থাকে না। আমার বয়স বেশি এবং আমি দেখতে
সুন্দরী নই। এই তোর অভিমত। তাহলে আমি কেন তার সাথে থাকব ? আমার থাকার মধ্যে
কি স্বার্থকতা ? শুধুমাত্র আমি একজন বিবাহিতা নারী এই পরিচয়ের জন্য ?
অসম্ভব। আমি এতটা তুচ্ছ এখনো নিজেকে ভাবি না। নিজের ভার নিজে বহন করার মত
সমস্ত কিছু এখনো আমার আছ্ ে। কারো উপর নির্ভরশলি আমি নই। কারো পরিচয়ে আমার
পরিচিতি দরকার নেই।
সেই রাতেই উনি বাসায় ফেরার আগে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। শুধু লিখে রেখে
আসি,তোমার সাথে থাকা আমার আর সম্ভব না।
তারপর আপনাকে সে খোঁজেনি ? আপনার বাবা মা কি বলেছেন ?
সে বাসায় গিয়ে আমাকে না পেয়ে চিরকুট পড়েই আমার আব্বাকে ফোন করে জানায় আমি
বাসা থেকে চলে গিয়েছি। আব্বাকে আরো বলে যে আপনার মেয়ের মাথা খারাপ। তেমন
কিছুই হয়নি তার সাথে। অথচ সে নাকি আর আমার সাথে থাকতে পারবে না। আব্বা
আমাকে ফিরে যেতে বলেছিল । আমি তাকে বুঝিয়েছি যে আমি যা করেছি তা ঠিক করেছি।
এ নিয়ে যেন আমাকে আর কিছু না বলে।
তারপর থেকে এই কর্মজীবি হোস্টেলই আমার ঠিকানা। অনেক ভাল আছি এখন। চাকরী
করছি,স্বাধীন মত ঘুরছি ফিরছি । কারো কথার ধার ধারি না। মন চাইলে খাই, না
চাইলে না। সংসার নামক বোঝাটা কাঁধে নাই। ছুটির দিন সারাদিন ঘুমাই। কেউ কিছু
বলার নাই। আসলে এই জীবনটা অনেক মজার রূপা। সেটা বুঝতাম না যদি ওই দুই
পুরুষকে আমি না চিনতাম।
যাক এবার চলো,পেটের খিদেটা মেটাই। অনেক তো কথা হল। তুমি আবার আমার মত হইও
না। তুমি অনেক সুন্দর আছ। আমার মত অভিজ্ঞতা তোমার হবে না। তবে হ্যাঁ ,পুরুষ
জাতকে বিশ্বাস করতে গেলে একটু বুঝে শুনেই করো। সবে তো এলে । দেখবে কত ভেলকি
বাজি যে তারা জানে। ওরা হল এক একটা বদমায়েশের হাড্ডি।
তা কেন আপু ? কেউ না কেউ তো ভাল আছে । সব যদি খারাপ হত তাহলে আমরা তো মোটেই
টিকতে পারতাম না।
ধুর বোকা। আমরা কি ওদের জন্য টিকে আছি নাকি ? আমরা যেটুকু টিকে আছি তা
সংগ্রাম করে আছি বলে। এই সংগ্রামটুকু না করলে ওরা আমাদের কদমে কদমে পিষে
মারত।
হোস্টেলে ফিরে এসে আবার কথা শুরু করল রেহানা। আজ তার মনের দুয়ার খুলে গেছে
। রূপাকে যেন সবই বলতে হবে। জীবনের সব কথাই যখন যেখান থেকে যেটুকু মনে পড়ছে
বলে যাচ্ছে। রূপাকে বলল,আজ কিন্তু সারা রাত গল্প করব রূপা। মনে আছে তো ?
তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়বে না তো ?
না আপু ,আমি তো মন দিয়ে শুনছি। আর আমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। রাত জেগে
পড়ার অভ্যাস ।
তারপর কথা বলতে বলতে রাত এগারটার একটু পরেই রূপা টের পায় রেহানার চোখ বুজে
আসছে। এখন বন্ধ চোখেই বলে যাচ্ছে। একটু থেমে থেমে। খানিক পর রেহানা গভীর
ঘুমে হারিয়ে গেল। রূপার খুব মায়া হল তার ঘুমন্ত মুখটি দেখে। আহারে কত কষ্ট
পেয়েছে জীবনে। আসলে জগতে সুখি কোন মেয়ে ? কেউই তো আসলে সুখি নয়। আল্লাহই
জানে আমার কপালে কি আছে ।
বুয়েটে রূপার হল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর জাহাঙ্গীর নগরে হল। মেডিকেলেও
হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামিস্ট্রিতে ভর্তি হয়ে গেল। ভর্তির পর একবার বাড়ি
গিয়েছিল রূপা। ক্লাস শুরু হতে যে ক’দিন সময় ছিল সেই ক’দিন সে বাড়িতে ছিল।
তারপর এসে রেহানার হোস্টেলেই উঠল। কিন্তু এখন আর সে এখানে থাকতে পারবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলের জন্য আবেদন করেছে। সেখানে সুযোগ পেলেই কর্মজীবি
হোস্টেল ছেড়ে চলে যাবে। রেহানাকে সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। বিনা স্বার্থে
সে রূপার জন্য অনেক করেছে। থাকতে দিয়েছে ,খেতে দিয়েছে। একজন অভিভাবকের মত
আগলে রেখেছিল। আর এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে নীরা আপুর জন্য।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|