|
জমিদার বাড়ির সমাচার
-
মেহেরুন নেছা রুমা
-
নিজের সুন্দর মুখশ্রীটা দেখতে যেয়ে জগতের সবচেয়ে বিশ্রী আয়নাটার দিকে চোখ
পড়তেই ঘেন্নায় সবকিছু গুলিয়ে উঠতে চাইলো। প্লাস্টিকের সবুজ রং এর পানির কলটি
তার নিজস্বতা হারিয়েছে অনেক আগেই। অনবরত পানি পড়তে পড়তে কলের নীচ থেকে মেঝে
পর্যন্ত দেয়াল ঘেঁষা কালচে সবুজ শ্যাওলার দিকে না চাইতেও চোখ পড়ে যায়
মেহবারের। এসব ব্যাপারগুলো এমনই। যতই না দেখতে চাইবে, মনে না করতে চাইবে,
এরা ততই যেন সাগ্রহে মনের মাঝে উঁকি মারে। এসব ব্যাপারে মেহবারের শুঁচিবাই
আগে এতটা প্রকট ছিল না; যখন এ বাড়িতে বসবাস করত তখন প্রয়োজনের তাগিদে
সবকিছুই সহ্য হয়েছিল। গোসলখানায় মুখ ধুতে এসে মেহরাবের মনে হল, কেমন করে এই
নর্দমার মধ্যে বাস করে এরা! এদের কী ঘেন্না টেন্না বলতে কিছুই নেই?
বছর খানেক আগে জমিদার বাড়ি ছেড়ে যখন এক কামড়ার নিজের ছোট্ট ঘরখানিতে উঠেছিল,
মেহরাব যেন প্রথমবার স্বাধীনতার স্বাদ পেল। যদিও মাসে মাসে ঘরটির জন্য ভাড়া
গুনতে হত, তবু সেটিই ছিল জীবনের প্রথম ‘নিজের ঘর’। চাকরিটা হলেই মেহরাব
বুঝতে পারলো ওই বাড়ির লোকজন এখন তার কাছে অন্যকিছু দাবী করছে। এখনকার সময়ে
এমন ভদ্র মার্জিত শিক্ষিত সুদর্শন আর বিনয়ের সমাহার এক মোড়কে কে কবে দেখেছে।
তার উপরে দামি চাকরি। ওই বাড়িতে থাকাবস্থাতেই বাড়ির চারটে মেয়ে এবং মেয়েদের
পিতা-মাতাগন এমনকি আত্মীয়-স্বজনরাও মনে মনে ধরেই নিয়েছিল যে মেহরাব কোনকালে
জমিদার বাড়ির জামাতা হবে। আর প্রতিটি কন্যার মাতা-পিতাই নিজেদের মধ্যে এই
নিয়ে মৌন প্রতিযোগিতা করতেন। সবই মেহরাবের বোধগম্য ছিল। কিন্তু তার মনের
ভাব মনেই রেখে দিল। ভিন্ন বাড়িতে যাওয়ার পর রোজই জমিদার বাড়ির লোকেরা ভাল
কিছু আয়োজন হলে মেহরাবকে ডাকতে ভুল করে না। ওই বাড়ির প্রতি অশেষ
কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মেহরাব কখনো তাদের কোন আবদার অস্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু
তাদের উগ্র দাম্ভিকতায় ভরা বেহিশেবী চাল-চলন কোনকালেই তার ভাল লাগেনি। আগে
নাকি ওই বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারত
না । তাহলে জামিদার বাড়ির লোকেরা তাদেরকে শাস্তি দিত। তাদের আরো অত্যাচারের
কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে। তবু মেহরাব ঢাকা শহরে প্রথম এসে একটু মাথা গোঁজার
ঠাই পেয়েছিল ওখানে। ওই বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলোকে পড়ানোর দায়িত্বে থেকে নিজের
লেখাপড়াটাও চালিয়ে গিয়েছিল। ওই বাড়ির ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার শখ মিটে যায়
স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগেই। মেয়েগুলো যেন ছেলেদের মালমশলা দিয়ে তৈরি।
মেহরাবেবর সাথে এমনভাবে মেশতো যেন ওরা বুঝতেই পারতো না ওদের জন্য এতটা
মাখামাখি নিরাপদ নয়। ভাগ্যিস মেহরাব সে ধরনের ছেলে নয়। নইলে রোজ ওই বাড়ির
কোন একটি মেয়ে তার সম্ভ্রম হারাতো। যদিও হারানোর কথা তাদের মনেই হয়নি কখনো।
কেননা তারা নিজেরাই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে বসে থাকতো মেহরাবের জন্য।
বাড়িটির বয়স সত্তর আশির কম হবে না। একসময় এলাকায় ওই একটিই পাকা বাড়ি ছিল।
আর বাড়ি থেকে যতদূর চোখ যেত চারদিকে তাদেরই জমিজমা। এখন উত্তরাধিকার সূত্রে
যারা বসবাস করছেন তাদেরও তিন পুরুষ আগে এই বাড়িটি জমিদার বাড়ি হিসেবেই
পরিচিত ছিল। জমিদারি ঠাঁট বজায় রেখে চললেও এখন বাড়ির মানুষদের রোজকার দানা
জুটে কারো না কারো কাছে ধার-দেনা করে। আর সেই ধার চাওয়ার মানুষগুলোর মধ্যে
মেহরাব অন্যতম। রোজ ওই বাড়ির কেউ না কেউ টাকা ধার চায় মেহরাবের কাছে। আগে
এমনটি হলে চক্ষুলজ্জা আর কৃতজ্ঞতার জন্য না করতে পারতো না। এখন সে বুঝে গেছে,
শত দিলেও ওদের স্বভাব বদলাবে না। আর অফেরৎযোগ্য ধার কেই বা কতদিন কাউকে দিতে
পারে?
চারভাই ঠেলাঠেলি করে বাড়িটির মেরামতের দিকে কখনো নজর দেয়নি। বসে বসে খেয়ে
সবই খোয়াতে হল। দেয়ালের চুন খসে গিয়ে ইটও খসে পড়ার যোগাড়। কার্ণিশ বেয়ে
গজিয়ে উঠছে বটবৃক্ষ সহ বহু লতা-পাতা। ছোট ছোট চারটি ঘরে চার ভাইয়ের বর্ধিত
পরিবারগুলো এমনভাবে বাস করছে যেন মেচবাক্সের কাঠির মত মানুষগুলো নিশ্বাস
নিতে আঁশফাঁস করছে। একই ঔরষজাত হলেও এরা কেউ যেন কারো নয়। চোখের আড়াল হলেই
একজন আর একজনের কুৎসা রটায়। এদের সবার কাছেই মেহরাব অতি প্রিয়জন। যেতে ইচ্ছে
না থাকলেও প্রায়ই ওই বাড়িতে যাওয়া হয় তার। কখনো তাদের আহবানে কখনো
কৃতজ্ঞতায় গড়া আত্মীয়তাকে মুছে দিতে না চেয়েই যাওয়া হয়।
বাপ-দাদার সম্পত্তির সবই আজ অন্যের মালিকানাধীন। বসে বসে খেলে রাজার ধনও
ফুরায়। আর এদেরতো মাত্র কয়েক বিঘা জমি। অন্ন জোগাতে একে একে সবই বিক্রী করতে
হয়েছে। রয়েছে শুধু বাড়িটা। মানুষের দেনা শোধ করতে সেটিও এখন যাই যাই করছে।
বাড়ির মেয়েগুলোর জন্য কোন ভাল বিয়ের প্রস্তাবও আসে না। ছেলেদের মধ্যে
দু’একজন বিয়ে করলেও বউ রাখার জায়গার অভাবে বউদেরকে বাড়িতেই আনতে পারে না।
অথবা তারা স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ সহ লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে একই ঘরে চোখ বুজে
বসবাস করছে।
খবরটি আচমকা শুনেই আসতে হল মেহরাবের। ওই বাড়িতে যা ই ঘটে সঙ্গে সঙ্গে
মেহরাবের কাছে খবর পৌঁছে যায়। আজ এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল দেরি করার কোন
উপায় ছিল না। অফিস থেকে বের হতেই ওই বাড়ি থেকে জরুরী তলব। তাই নিজের বাসায়
না যেয়েই অফিস থেকে সরাসরি ওখানে যেতে হল মেহরাবকে। বাড়িতে পা রেখেই মনে হল
ভেতরে লোকজন আছে। ঘরের সামনে অনেকগুলো জুতো । সবই অভিজাত কোন পুরুষ মানুষের
বলে মনে হল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল মেহরাবের শামীম মামা সহ জনা চারেক মানুষ।
আগত লোকদের সাথে কথা বলার মত উপযুক্ত কেউ এই বাড়িতে নেই বলেই এরা মেহরাবকে
জরুরী খবর দিয়ে নিয়ে আসে। সব শুনে মেহরাব তো হতবাক। মাত্র একদিনে কী ঘটে
গেল!
মেহরাবের দূর সম্পর্কের মামা শামীম একটি সরকারী অফিসে চতুর্থ শ্রেনীর
কর্মকর্তা। পদ ছোট হলেও তার সাথে দেশের বাঘা বাঘা মানুষদের সম্পর্ক। তাকে
দিয়ে হয় না এমন কোন কাজ নেই। সেই মামা একদিন মেহরাবকে খুঁজতে ওই বাড়িতে যায়।
বাড়ির লোকজনের সাথে মেহরাব তাকে পরিচয় করিয়ে দিলে প্রথমেই অতগুলো সমন্ত মেয়ে
দেখে মামার মাথা ভরকে যায়। মনে মনে আশ্চর্য হয় এই ভেবে যে, এ বাড়িতে থেকে
কেমন করে মেহরাবের মত ছেলে এখনো ব্যাচেলরই থেকে গেল! সেদিনই ওই বাড়ির মেঝ
মেয়েটি মামার মনে ধরে গেল। কিন্তু বাড়ির অবস্থা দেখে কিছুতেই তার পছন্দ হল
না। এত নোংরা পরিবেশ যেন বস্তিকেও হার মানায়। এরপর মামা জমিদার বাড়ির
চিন্তাটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারলেন না। এদের অবস্থা পালটানোর জন্য
উপায় খুঁজতে লাগলেন এবং পেয়েও গেলেন।
মামার সাথে একটি বেসরকারী ব্যাংকের এক পরিচালকের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক
থাকার সুবিধাটা নিতেই হল। তাকে ধরতেই ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা লোন করার
অনুমতি পেয়ে গেলেন মামা। আজ মামা সেই ব্যাংকের লোকদেরকে বাড়িটা দেখাতে নিয়ে
আসছেন। সেই বিষয়ে কথা বলার জন্যই এ বাড়ির পক্ষ থেকে মেহরাবকে ডাকা হল।
মামার এমন কীর্তি, আর জমিদার বাড়ির ভাগ্য দেখে মেহরাবের চক্ষু চড়কগাছ। এক
বছরের মধ্যে এখানে পনেরো তলা এপার্টমেন্ট উঠে যাবে। সেখান থেকে কিছু বিক্রী
করে ব্যাংকের লোন শোধ করা হবে। আর সবকিছু করে দেয়ার জন্য শামীম মামা একটি
ফ্লোর পাবেন, এই চুক্তিতেই সবাই রাজি হল। আর মামা যে ওই বাড়ির জামাতা হবার
ইচ্ছাটা মনে পুষে রেখেছেন সেটাও বাড়ির লোকদের অজানা নয়। তাতেও তারা খুশি।
বাড়িও হল, আর এমন কাজের মত একটা জামাইও পাওয়া যাবে। যদিও মামার বয়সটা
চল্লিশের কোটায়, তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
ভাবতে ভাবতে রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাবার যোগাড়। মেহরাব জীবনে এমন আশ্চর্য
খুব কমই হয়েছে। মাত্র এক বছরে পালটে যাবে জমিদার বাড়ির চেহারা-আর ওই বাড়ির
মানুষগুলো! আজ বড় আন্টি পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি বললেন, বাড়িটা হয়ে
গেলে তুমিও এসে আমাদের সাথে থেকো। বাড়ি হবে শুনে কত ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব
আসছে আমাদের ঝুমুরের জন্য। কিন্তু আমি তোমার আংকেলকে বলে দিয়েছি, হাতের
কাছে এমন হীরে থাকতে বাইরে নজর দেয়ার কী দরকার। মেয়ের জন্য এমন স্পষ্ট টোপ
পেয়েও তবু স্পষ্ট করে তাকে বলতে পারল না মেহরাব, আপনারা যতোই উপরের তলায়
উঠেন না কেন এমন বাড়ির লোভ কিংবা আপনাদের মেয়ের লোভ কোনকালে আমার ছিল না।
জমিদার বাড়ির অংশীদার কোনদিন হব না আমি। কেননা এদের রক্তে মিশে আছে কত কত
মানুষের দেয়া অভিশাপের দীর্ঘশ্বাস!
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|