ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১০)
শাশ্বত স্বপন
গ্রাম অঞ্চলে আজো মেয়েরা
আই.এ, বি.এ নয়, বিয়া পাশ করার জন্য লেখাপড়া করে। যেন ভাল বর পাবার জন্যই
তাদের এ লেখাপড়া। বর পক্ষরা কনের হাতের লেখা দেখে শিক্ষার মান যাচাই করেন।
তাই মেয়েরা হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। তাছাড়া নিজের
ভবিষ্যৎ সন্তানদের প্রাথমিক জ্ঞান দানের জন্যও তাদের ‘বিয়া পাশে’র লেখাপড়া
কাজে লাগে ।
কালী কবিতা লিখতে পারে। কিন্তু কাউকে দেখাতে পারে না। বেশ লজ্জা হয়। একবার
একটা কবিতা লিখে সারা স্কুলে ঝড় তুলেছিল । অনেকেই তাকে খারাপ বলেছে।
দু’একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে ‘পাকনা’ মেয়ে বলেছে। চঞ্চুরী কিশোর সংঘ তার
কাছে একটা কবিতা চেয়েছে দেওয়ালিকায় ছাপানোর জন্য। সে আগের লজ্জার কথা স্মরণ
করে কবিতা দেয়নি। ক্লাশের শিক্ষিকা দীপ্তি আপা কবিতা দিয়েছে। সে বয়স্ক বলেই
হয়তো পেরেছে। মেয়েরা প্রেম নিয়ে কিছু লিখলেই সবার মনে সন্দেহ হয়, মেয়েটি
বুঝি প্রেম করে অথবা ছ্যাকা খেয়েছে। আসলে সমাজে অভ্যস্ততা নেই বলেই এত
বিড়ম্বনা। খেলা নিয়েই কত কথা উঠে। স্কুল পর্যায়ে খেলার পরই উপজেলা পর্যায়ে
খেলা। কালী সাঁতার, দৌড় ও হাইজ্যামে অংশগ্রহণ করবে। গত বছর জেলা পর্যায়ে সে
দৌড়ে সেকেন্ড এবং হাইজ্যামে থার্ড হয়েছে। এবার আরো ভাল করার ইচ্ছা। কিন্তু
ছেলেদের মত কোথাও সে দৌঁড় প্রেক্টিজ করতে পারে না। মাঠে সকালে একদিন দৌঁড়াতে
গিয়ে দেখে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। নাসরিন মাঠের একপ্রান্তে ব্যায়াম শুরু করল।
কালী মাঠের সাইড দিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করল। ছেলেরা তা দেখে হাসাহাসি করতে
লাগল। নাসরিনের বড় ভাই তখন ফুটবল খেলছিল। সে দু’জনকে ধমক দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে
দেয়। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে প্রেকটিস করতে কালীর মোটেও ভাল লাগে না। তখন সে
থাকে ক্ষুধার্ত, তবুও একটু আধটু করতে হয়। ধানমন্ডিতে মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে,
ফুটবল খেলছে অথচ গ্রামে এসবের কি হাস্যকর অবস্থা। এখানে নারীকে ঠেলে দেওয়া
হয় পশ্চাতের ইতিহাসে, বাল্যবিবাহে, পারলে সতীদাহে বা আত্মঘাতির দিকে।
গ্রামে বাল্য বিবাহ সবচেয়ে বেশী হয়। যদি একটা ছেলে কোন একটা মেয়ের পিছনে
লাগে তবে মেয়ের মা-বাবা ও অভিভাবকগণ পাত্র দেখতে শুরু করে দেন আর যদি মনের
আনন্দের জন্য ভালো লাগে বা মিনি বিনোদনের খোরাক হিসাবে কোন ছেলেমেয়ে প্রেম
করে তবে ছেলেতো ছেলে থাকেই; মেয়ে, হোক সে বালিকা কিংবা কিশোরী, আত্নজ্ঞানী
অভিভাবকরা তাকে বউ বানিয়ে বরের হাতে তুলে গ্রাম ছাড়া করে দীর্ঘ একটা
নিঃশ্বাস ছাড়েন। এ নিঃশ্বাস কখনও শান্তি কখনো অশান্তি বয়ে আনে। কিন্তু
শান্তি-অশান্তি যাই বয়ে আসুক, কন্যাকে বিদায় না করে স্বস্তি পায় না। কন্যার
প্রেম যদি সমাজে ছড়ায় তবে নাকি তাদের মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়ে। যারা বদনামকে
এড়িয়ে চলে, গ্রহন করতে ঘৃনাবোধ করে, বদনাম তাদের ঘড়েই এসে ভর করে। প্রেম
করা আমাদের সমাজে যেন মহাপাপ এবং সব দোষ যের শুধু কন্যার। প্রেম মহৎ, প্রেম
আল্লার দান-- এসব যারা বলে অথবা যারা প্রেম ছাড়া সিনেমাকে সিনেমা মনে করেন
না। সিনেমা দেখতে গিয়ে অভিভাবকরা নায়ক-নায়িকাদের পক্ষে থাকেন আর ভিলেনকে
বকতে থাকেন কিন্তু তাদের কন্যা বা বোন যদি প্রেম করে বসে, তখন তার নিজেরাই
ভিলেন বনে যান। অপরের যত ক্ষতি--তা মহৎ বলেও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু নিজের
ক্ষতি--তা যত মহৎ-ই হোক মেনে নেওয়া বড় কষ্ট।
জন্মের পর থেকে মেয়েরা পিতামাতা আর নারীত্বের নিয়মে বন্ধি থাকে। সমাজে
নারীদের জন্য যা সিদ্ধ, হোক সেটা ভাল বা মন্দ--পিতা-মাতারা সমাজের মান
রক্ষার্থে তাই করে। যেমন, অতীতে ধর্ম ও সমাজের মান-ইজ্জত বাঁচাতে সতীদাহ
নামক উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত ভয়ঙ্কর একটা প্রথা ছিল। চিরবিধবা নামক
কুসংস্কার, স্বার্থসম্বলিত একটা রীতি ছিলো, আজো বহু অযৌক্তিক নিয়ম সমাজে
আরশোলার মত বেঁচে আছে। সবাই বলে মা-বাবা যা করেন ছেলেমেয়েদের মঙ্গলের জন্যই
করেন। তারপর মা-বাবার মঙ্গল সিদ্ধবিবাহ দেবার পর দৈবক্রমে কন্যা যদি
রিটান্ট বাপের বাড়ী ফিরে আসে তখন কেউ কেউ হয়তো বলে মা-বাবা দেখে শুনে বিয়ে
দেয় নাই? কিন্তু অধিকাংশ বলবে মেয়ের ভাগ্য খারাপ। কেউ বলবে অলক্ষ্মী? মেয়ে।
শুভস্য শীঘ্রম আর শুভ লগ্ন দেখে বিয়ে দিয়েও নব্বই শতাংশ বর কনে যে
অসুখী--সে কথা ভ্রুনাক্ষরে কেউ ভাবে বলে মনে হয় না। এত অগ্নি, বায়ু, মাটি,
স্বর্গীয় পাঁচ পুরুষ ইত্যাদি সাক্ষী ও আর্শীর্বাদ দ্বারা বিয়ে হয়, তারপরও
বিয়ে ভেঙ্গে যায়, সংসার অশান্তিতে ভরে থাকে।
গ্রাম অন্চলে ছোট ছোট মেয়েরা ভোর সকালে উঠে শীতকালে এক মাস সূর্য পূজা করে
। গুনে গুনে পাঁচ বছরে পাঁচ বার করতে পারলে পঞ্চম বারের শেষের দিন পাড়ার
লোকদের নিমন্ত্রণ করে এবং সূর্যের সাথে অভিভাবকরা বিয়ে দেয়। ঠিক বিয়ের মতই
নিয়ম-কানুন। সুর্য থাকে আকাশে আর লাল আবির দিয়ে আঁকা সূর্য মূর্তি থাকে
উঠানে। বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকা ছবি বেশ তেজদীপ্ত থাকে। সূর্যের সাথে বিয়ে
দেবার পর শুরু হয় ভোজন। অবশেষে, সবাই আর্শীবাদ করে, বড় হয়ে এই শিশু কন্যা
যেন সূর্য দেবতার মত বর পায়। কিন্তু আমার দেখা মতে, আমি অনেক মেয়ের সংসার
জীবন দেখেছি। দেখেছি মেয়েদের কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি ফিরতে। সেই মেয়েদের
প্রত্যেকেরই ছোট বেলায় সূর্য দেবতার সাথে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সূর্য
দেবতার মত এমন তেজী বর, যৌতুক মার্কা শ্বশুর আর ঝগড়াটে শ্বাশুরী পেয়েছে--যা
তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। আমার মনে হয় গতানুগতিক বিশ্বাসের ফলেই এসব কুসংস্কার
আজো প্রবাহমান। এগুলো যদি বাঙ্গালীর সংস্কৃতি হিসাবে মেনে নেওয়া হয়, তবে তা
হবে গ্রহণীয়। অথচ ধর্মের এতসব অতীত, বর্তমান কুসংস্কার দেখে, শুনেও পন্ডিত
প্রফুল্ল বন্দোপাধ্যায় কেমন করে বললেন, হিন্দু ধর্ম অতি আদি এবং বিজ্ঞান
সম্মত বলেই আজো টিকে আছে। মনে হয়, আরশোলা তত্ত্ব। বাবরী মসজিদের মত পাঁচশ
বছরের পুরনো ভারতীয় ঐতিহাসিক সম্পদ যারা রামের মান রক্ষার্থে, ধর্ম
রক্ষার্থে ভেঙ্গেছে তারা আসলে ধর্ম ব্যবসায়ী নাকি রামের হনুমানের বংশধর
অনুসন্ধান করতে ইচ্ছে করে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |