ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১৪)
শাশ্বত স্বপন
কালীর শরীর হল মোটাসোটা,
খাট দেহ। দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় হালকা-পাতলা। কিন্তু কাছে এসে
ভাল ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে--মোটা শরীরের মাংসপেশীগুলি অত্যন্ত সবল আর
কর্মঠ--অনেকটা খেলোয়াড়দের মত। সারাক্ষণ সে হাসি-খুশী থাকে। বুকের ভিতরে
লুকিয়ে রাখে প্রচন্ড জ্বালা-যন্ত্রণা। একেবারে কাছের মানুষ শিখা, নাসরিন আর
দীপা-- এদের কাছেও দুঃখের কথা বলে না। শিখা, নাসরিন, দীপা--এরা সবাই ফর্সা
আর মুখের গড়নও ভাল। তাই অনেকেই তাদের পাওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখে, পিছু পিছু
ঘুরে, চিঠি দেয়। অথচ এই চিঠিওয়ালারাই কালীকে পেতে চায় অন্যভাবে। শিখাকে যে
ছেলে ভালবাসে, যার গুনগান শুনতে শুনতে কালীই ক্লান্ত হয়ে যায়। সেই ছেলে
কালীকে ধঞ্চে ক্ষেতের আড়ালে পেয়ে সুপ্ত কামনার কথা বলেছিল। কালী সে কথা
শিখাকে কোনদিন বলেনি। যা তার জন্য নিষিদ্ধ-- তা অন্যের জন্য সিদ্ধ। ছেলেটি
হয়তো তার জন্য বিষাক্ত কিন্তু শিখার জন্য বটবৃক্ষের ছায়া।একজন মানুষ সময়ে
ফেরেস্তা, সময়ে সয়তান।কালী পুরুষ বিদ্ধেষী নয়। সে দোষারোপ করে সেই মানুষ বা
মানুষদের যে বা যারা সুন্দর আর কালোর এরকম বিভৎস্য বিভেদ সৃষ্টি করেছে। সে
মাঝে মাঝে আবেগাপ্লুত হয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করে। আবার ভাগ্যকে অস্বীকারও করে।
কালীর দেহের লোমগুলি সুষ্পষ্ট। সাধারণত মেয়েদের লোমগুলি যা হয়, তার চেয়ে
কালীর লোমগুলি একটু বড়। খসখসে হাতের তালু। তালুতে অসংখ্য দাগ যেন,
বাংলাদেশের দ্বিখন্ডিত মানচিত্র তার দুই হাতে আর মানচিত্রের বুকে জালের মত
অসংখ্য প্রবাহমান নদ-নদী। চোখ দু’টি ডাগর ডাগর। চোখের মণির রং কালো। আবার
হালকা লালচে-কালোও মনে হয়। যাই হোক, চোখে তেমন কোন মাধুর্য নেই, দু’লাইন
কবিতাও লিখা যাবেনা সুন্দরের কাছ থেকে শব্দ ধার করে। আছে এক সুতীব্র
জ্বালা। মণির চারপাশে সাদা অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল রংয়ের বিন্দু। চোখ যেন
ভবিষ্যৎ কোন দ্রোহ জীবনের মুক্তির পতাকা বহন করে। মিশকালো মোটা ভ্রু’জোড়া
চোখের একেবারে কাছে। রংধনুর মত বাঁকা হলেও দৈর্ঘ্য বেশ ছোট। হঠাৎ করে দেখলে
মনে হয়, সাড়া সুখে কোন লাবন্য নেই । কিন্তু অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালে
দেখা যাবে, পৃথিবীর কোন এক সুপ্ত লাবণ্য অপরুপ দ্যুতিতে জ্বলজ্বল
করছে।সুন্দরী এক নারী তার ভিতরে যা কালো রংয়ের ফ্রেমে বন্দী হয়ে আছে এবং যা
কেবলমাত্র মনের চোখ দ্বারাই দেখা সম্ভব।কিন্তু সেই চোখ কয়জনের কাছে ? তবে
হ্যাঁ, পাশা কালীর কাছ থেকে বই ধার নিতে এসে বলেছিল, আপনার মনটা খুব
সুন্দর--তাইতো এত সুন্দর সুন্দর বই আপনার সংগ্রহে...। পাশার প্রথম লাইনটাই
কালীকে অবাক করেছিল, তারপর কি বলেছিল তা কালীর কানে প্রবেশ করেনি। পরে কালী
ভাবল তার মনটাকে সুন্দর বলা হয়েছে-- দেহটাকে নয়, তাকে নয় ।
নাকটা বেশ মোটা, মাংসল। খাট কপাল। কপালে দু’একটা নখের দাগ। চঞ্চলা আর
মেজাজী বলেই জয়ের সাথে তার প্রায় হাতাহাতি হয়। পিটাপিটি ভাই-বোন। একবার জয়
মারামারিতে হেরে হাতের নখ দিয়ে কপালে দাগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি মুখের
গড়নটা গোলক তবে পুরোপুরি গোলক নয়--অভিগত গোলক। ঠোঁট লালচে বাদামী হলেও
গাঁয়ের রং এর জন্য কালোই মনে হয়। তবে বেশ মসৃণ আর তেলতেলে। হাসি এত সুন্দর
লাগে যে সহসা কেউ কেউ বলেই ফেলে হাসিটা সুন্দর। কালো দেহ আর মুখ এর জন্য
হাসির সৌন্দর্য স্পষ্ট ফুটে উঠে না। সুন্দরী নারীদের এ রকম হাসি মুখ থাকলে
তারা আরো সৌন্দর্য মুখর হন।
যাই হোক কালীর মাথা ভরা চুল।রুপের বাহারে সুন্দরী না হলেও চুলের দৈর্ঘ্য
ছিল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। মুখের ঠিক নীচে চিবুকের কাছে ছিল একটা বড় তিল।
কালী তিলটাকে প্রতিদিন মুখ দেখার সময় একশ এক বার নরকে পাঠায়। হাত-পা আকারে
মাঝারী হলেও বাহির হতে দেখার মত কিছু ছিল না। কালো হাত যেমন রাজনীতিতে
ঘৃণিত, তেমনি কালীর কালো হাতই নয়, সমস্ত দেহ সমাজে মুল্যহীন, ঘৃণিত। সে এতই
কালো যে রাতের আঁধারের সাথে একাকার হয়ে যায়। একবার কালী শিখাদের বাড়ী থেকে
রাত করে বাড়ি ফিরছে। শিখা অনেকটা পথ হারিকেন দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে। নিতাই
শীলের বাড়ীর উঠান দিয়ে আসতেই গর্জন ভেসে এল--
-- কে? কে যায় উঠান দিয়ে?
--আমি
--আমি কে?
-- আমি কালী--
‘আমি কালী’ -- কথার স্বর বেশ মোটা হওয়ায় নিতাই শীল চমকে উঠেন। ভয়ে আর
জানালা খুললেন না। গত বছর তার স্ত্রী মারা গেছে। সেই শোকে শোকে আর
বার্ধক্যের চাপে এ বছর কালী পূজা দেওয়া হয়নি। তাই হয়তো মা কালী স্বয়ং তার
উঠানে এসে হাজির। সময় নষ্ট না করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন--
-- রক্ষা কর মা কালী, আমাকে রক্ষা কর। এ বছর তোমাকে পূজা দিতে পারি নাই।
কালী তার ভুল ভাঙ্গাতে বলে উঠল--
--দাদা, আমি দেবী কালী না, আমি কালীপদের মেয়ে কালী--
নিতাই শীল তড়িঘরি করে হারিকেন হাতে নিয়ে জানালা খুললেন।
-- দূর, দূর! এত রাতে তুই এখানে কি করিস? নারিকেল চুরি করতে আসছিস ?
অন্ধকারে দেখাও যায় না। দূর হ অলক্ষ্মী মেয়ে--
কালী মন খারাপ করে হাঁটতে থাকে। ভাবে, দেবী কালী হয়েও কত ক্ষমতাশালী। মানুষ
কত ভয় পায়। স্বয়ং দেবের দেব মহাদেব তার স্বামী অথচ সে...। কালী ভাবে, যদি
সে দেবী কালীর মত প্রলয়কারী হতে পারত...। নিতাই শীল অনর্গল বকেই চলেছে, ছিঃ
খোদাই ষাড় মেয়ে! রাত নেই, দিন নেই, মুসলমান ছেলেদের সাথে রং ঢং করে। বাপে
হাজার চেষ্টা করেও পারছে না বিয়ে দিতে। মেয়ের সেই চিন্তা আছে? কত টাকা যে
লাগবো পার করতে, ভগবানই জানে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |