ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১৫)
শাশ্বত স্বপন
গতকাল পাশা দোকান থেকে
এসে কালীকে একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দেয়। এই ম্যাগাজিন প্রতি সপ্তাহে
কালীর মাসী তনিমা দোকানের ঠিকানার পাঠায়। তনিমা সাপ্তহিক ‘নারী চেতনা’র
একজন নিয়মিত লেখিকা। ম্যাগাজিনের লেখা কালী ক্লাশে বান্ধবীদের নিয়মিত পড়ে
শোনায়। এবারের ম্যাগাজিনে তনিমা মাসীর লেখা কালী পড়া শুরু করল-- ‘অনেকে
ধর্ম মানে না, স্রষ্টাও বিশ্বাস করে না। তারা বলেন, দুনিয়াতে যত দ্বন্ধ
হয়েছে তার অধিকাংশই ধর্ম নিয়ে। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে, যে
কোন দ্বন্ধেই কম-বেশী ধর্মগন্ধ রয়েছে। কথাটি মানি কিন্তু ধর্ম কি বর্বরতা
থেকে সভ্যতা আনেনি ? পৃথিবীকে তো ধর্মই রক্ষা করছে। এই কথার প্রসঙ্গে কট্রর
নাস্তিক হয়তো বলবে, ধর্ম যদি পৃথিবী রক্ষা করে থাকে তাহলে ১০০% সিউর, ধর্মই
পৃথিবী ধ্বংশ করবে। খন্ড খন্ড ধর্মবিভেদ দ্বন্ধই হবে সেই ধ্বংশের একক। এই
কথাটি কতটুকু সত্য--কতটুকু মিথ্যা তা বিচার করার দায়িত্ব পাঠকের কাছেই থাক।
বিজ্ঞান আশীর্বাদ আবার অভিশাপ বটে। এটা নির্ভর করে মানুষের ব্যবহারের উপর।
ধর্মও তেমনি; মানুষ যদি ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করে; ধর্মভাইদের আপন ভেবে
বিধর্মীদের অবজ্ঞা করে তবে তো ধর্ম অভিশাপ হবেই। আজকের পৃথিবীতে সব ধর্মের
মানুষেরাই চায়, তাদের ধর্ম অন্য ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করুক। যে কোন
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিরা সংখ্যালঘুদের বিভিন্নভাবে খাট করে। যদিও এসব
ধর্মের কোন পাতায় লেখা নেই, তবু করে। কেন করে ? তবে কি ধর্মের পাতার অদৃশ্য
কোন হাতছানি আছে। এক নাস্তিক আমাকে বলেছিল, এক ঈশ্বর, তার হাজার হাজার ধর্ম
কেন? সব ধর্মেই যখন তিনি আছেন তবে এত ধর্মান্তর কেন? এত দ্বন্ধ কেন ? মানুষ
কি জেনে-শুনেই ভুল করছে ? আরেক দিন আমাকে এক হুজুর বলেছিল, এক মুসলমান ছাড়া
অন্য কোন বিধর্মী বেহেস্তে যেতে পাবে না। তখন আমি বলেছিলাম, আচ্ছা, হুজুর
আমাদের তো আল্লাই পাঠিয়েছেন। ?
- হ্যাঁ-
- আপনাকেও তিনিই পাঠিয়েছেন।
-অবশ্যই--
-তাহলে আল্লাহ আপনাকে মুসলমান ঘরে আর আমাকে হিন্দু ঘরে পাঠিয়েছেন। কেন ?
তিনি যদি পাঠানোর সময় বলতেন ইসলাম ধর্মে গেলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে, অন্য
কোন ধর্মে গেলে যাওয়া যাবে না। তাহলে নিশ্চয়ই আমি মুসলমান ঘরে আসতে চাইতাম।
- তাহলে এখন আসেন--
-আপনি আমার মত হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়ে পরে ইসলাম ধর্মে আসতেন ?
-অবশ্যই, ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম, শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
-তাহলে শুনুন, আমাদের ধর্মেও লেখা আছে গীতা পাঠ করলে, কাশী-বৃদ্ধাবন ঘুরলে,
লাঙ্গল বদ্ধে স্নান করলে সব পাপ দূর হয়। পূজা-পার্বন করলে দেব-দেবীরাও খুশী
হয়। স্বর্গ এ ধর্মেও পাওয়া যায়। আপনি টুপি, পাঞ্জাবী খুলে ধুতি পড়ুন। টিকি
রাখুন। পারবেন?
- আসতাগ ফিরুল্লাহ--
- ভয় নেই--আমাদের ধর্মে বিধর্মীদের প্রবেশ নিষেধ। আপনাদের মত মানুষেরাই
ধর্মে অভিশাপ স্বরূপ। আপনারাই ধর্মের বিকৃত ব্যবহার করেন। যত ফতুয়া সব
আপনাদের এই উর্বর মাথা থেকেই আসে! নূরজাহানের বিচার কি বিভৎস্য ! আপনার
বিবেক কি বলে ?আপনার মত মুষ্টিমেয় হুজুররা এমন সব কাজ করেন যার সব কিছুর
দায়ভার সব হুজুরের উপর পরে। এক আল্লাহ সবাইকে পাঠিয়েছেন। হয়তো বিভিন্ন
বিশ্বাসে। কিন্তু মূল বিশ্বাস একটাই। যত মত তত পথ। যে লোক যে ধর্মে অবস্থান
করে তার আরাধনা করে--সে তার আরাধনার ফল লাভ করতে পারে।
হুজুর আর কোন কথা বলেনি। তবে একটা ব্যাপার স্বীকার করতে হয়, হাজার বছরের
পুরনো বিধি হয়তো বর্তমানে খাপ খাওয়াতে পারছে না। আধুনিক সমাজে তাই অনেকেই
ধমের অনুশাসন মানতে চয় না।মানুষের রুচি চাহিদা, পোশাক আশাক, মন-মানসিকতা
অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে সতিদাহ, চিরবিধবা প্রথা চিন্তাই করা যায়
না।চিন্তা করা যায় না আরো অনেক বিধি। নারীরা আজ নারী-পুরুষ বিভেদ ভুলে
বোরকা ছেড়ে শার্ট, প্যান্ট, স্কার্ট পরিধান করা শুরু করেছে। চিতা বিজ্ঞান
সম্মত, কিন্তু এ অত্যাধুনিক যুগে এতো নিষ্ঠুর শাস্তি জনসম্মুখে কল্পনা করাও
ভীতিজনক। নরক ভোগ যদি মানুষ দ্বারাই এ পৃথিবীতে হয় তবে পরলোকে বিশ্বাস কেন
? বিজ্ঞানসম্মত বলে অনেক কিছুই পার পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক বিধিইতো বিজ্ঞান
সম্মত নয়।এমনকি বিজ্ঞানের সামান্য চিন্তা দিয়েও কল্পনা করা যায়না, সে সব
বিধি কেন বিজ্ঞান থেকে দূরে রাখা হয় ? বিজ্ঞানের যেমন দোষ ত্রুটি
আছে,ধর্মেও তেমনি। ব্যবহারের সুক্ষতাই সুন্দর করে চলমান সত্যিকে। আমাকে
আমার ভাগ্নী উষা বলেছিল, ধর্মের মূল ভিত্তি হল বিশ্বাস। একটা তাবিজ দিয়ে
যদি বলা হয় আমি সুন্দরী হয়ে যাব-- তা কি কেউ বিশ্বাস করবে? এটা পাতা পড়ে
দেবতা নড়ে-- সেই যুগ নয়। বিশ্বাসের দিন ফুরিয়ে গেছে।এখন আর নতুন নতুন ধর্ম
প্রবর্তক সৃষ্টি হয় না। রাম-সীতা গল্প হয় না। দ্রোপদীর মত চরিত্র সে যুগে
কোন অদৃশ্য শক্তি বলে মেনে নেওয়া হয়েছে জানি না, আমাদের সমাজ তা চিন্তাও
করতে পারে না। তবে গোপনে দ্রোপদীর চরিত্র সব দেশেই সব ধমের মানুষের মধ্যেই
আছে।”
কালী নিবন্ধটি পাঠ করার পর বান্ধবী ইতি বলল, তোর মাসীকে নাস্তিক নাস্তিক
মনে হয়।
ববি বলে উঠল, আরে হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে।
জোহরা চিৎকার করে উঠল, তাহলে তোর চৌদ্দগোষ্ঠী বেহেস্তে যাবে।
নাসরিন বলল, তোরা যে যাই বলিস কালীর মাসী কিন্তু সত্য কথাই লিখেছে। তোরা
আগের সাপ্তাহিক গুলিতো পড়িসনি।
ববি বলল, কিন্তু আমাদের ধর্মের সামান্য আয়াতও পরিবর্তন করা যাবে না।
কালী বলল, তোদের ধর্মের কথা আলাদা। কিন্তু আমাদের ধর্মের প্রচলিত অনেক নিয়ম
পরিবর্তন হয়েছে। আরো পরিবর্তন দরকার। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, চিতাও বন্ধ হওয়া
উচিত। বাল্য বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ হলেও তার প্রয়োগ নেই। মুখে মুখে
বর্ণ-বৈষম্যের চৌদ্দগোষ্ঠীকে সবাই নরকে পাঠালেও পাল খুঁজে পাল, দাস খুঁজে
দাস, ব্রাক্ষণ খুঁজে ব্রাহ্মণ, শূদ্র খুঁজে শূদ্রকে। বর্ণ বৈষম্য বন্ধ করার
ব্যহারিক প্রয়োগ না করলে দেখবি ভারতবর্ষেও হিন্দু হ্রাস পেতে থাকবে। যে
বিশ্ব একদা হিন্দুতে পরিপূর্ণ ছিল, সে বিশ্ব আজ নড়বড়ে অবস্থায় ভারত,
নেপালের মত ভূ-খন্ডে ঠাঁই নিয়েছে এবং এ দুটি দেশই হিন্দু ধর্মের শেষ চিহ্ন।
কুসংস্কার সব ধর্মেই কমবেশী আছে। আমাদের নির্দিষ্ট কোন ধর্ম প্রবর্তক না
থাকায় কুসংস্কার যুগে যুগে ধর্মের পাতায়, মানুষের মনে স্থায়ী ঠাঁই করে
নিয়েছে। এসব কুসংস্কার সব সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।
নাসরিন বলল, দেখ কালী, সব কুসংস্কার উপড়ে ফেলতে চাইলে, দেখবি সংস্কারের
মূলে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে গেছে।
শিখা বলল, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং বিধবা বিবাহ চালু
করে গেছেন, আইন পাশ করা আছে অথচ বাল্যবিবাহ যেন ঈশ্বর চন্দ্র আর আইনকে
বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে আপন গতিতে চলছে। আর বিধবাকে বিয়ে করতে কে চায় ? হয়তো
কোন ল্যাংড়া, অন্ধ, বৃদ্ধ--এছাড়া আর কে আসবে ? এত সধবা মেয়ে থাকতে কেউ
বিধবা বিবাহ করতে চায়। সমাজ যেটুকু লজ্জা দেয় বা ঘৃনা করে ব্যক্তি করে তার
চেয়ে বেশী।
শীলা বলল, ও তোদের বলা হয়নি, আগামী পরশু লতার বিয়ে।
ববি বলল, লতাতো তবু নাইন-এ উঠেছে। উর্মিলার তো সিক্স-এ থাকতেই বিয়ে হয়ে গেল
।
ইতি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, ঐ স্যার আসছে, চুপ কর।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |