আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর কান্না গল্পটি
পিছিয়ে থাকা সমাজের দর্পণ
শাশ্বত
স্বপন
মৌলবী আফাজ আলী, বাড়ি
বরিশালের বাকেরগজ্ঞের কৃষ্ণকাঠিতে; ঢাকার এক বড় গোরস্তানে লাশ দাফন, জিয়ারত,
মোনাজাত, কবর দেখাশুনা—ইত্যাদি কাজ করেন। মালি কাম গোরকোন তার সহকারী শরীফ
মৃধাকে দিয়ে মুর্দার আত্মীয় স্বজনের অর্ডার অনুযায়ী কবরের আগাছা ছাঁটা, ঘাস
গজানো, গাছ লাগানো ও ফুল ফোটানো ইত্যাদি কাজও তাকে করতে হয়। এসব কাজের জন্য
সারাদিনই তাকে গোরস্তানে থাকতে হয় এবং যে যা দেয়--এরকম রোজগার নিয়ে তার
গ্রামের সংসারটি কোন মতে চলে। তবে বছরের মধ্যে সবে বরাতের রাতে তার সবচেয়ে
বেশী ব্যস্ত থাকতে হয় এবং সবচেয়ে বেশী রোজগার হয় ।
মুর্দার পার্টির অবস্থা বুঝে তার মোনাজাতের ধরন, সময়, আবেগ, কান্না নির্ভর
করে। তার ছেলে হাবিবুল্লাহর বন্ধু মনু মিয়ার ভাষ্যে, ‘তাদের কৃষ্ণকাঠির
আফাজ আলি মৌলবী ঢাকার এত বড়ো বড়ো মানুষের শোককে কিভাবে উস্কে দিচ্ছে তাই
দেখে সে অভিভূত।’ কখনো কখনো পার্টির টাকা নেবার পর কাজ ঠিকমত না করলে নানা
কথা শুনতে হয়। যেমন, গল্পের ভাষায়, মোনাজাতে শামিল না হয়ে শ্বশুরের কবরের
সামনে কাঁচা-পাকা চুলের লোকটি সিগ্রেট ধরায়। বেয়াদপের একশেষ। সিগ্রেট টান
দিতে দিতে আফাজ আলীকে খামোখা বকে, ‘আপনারা গোরস্তানে ব্যবসা ফেঁদেছেন তো
ভালই, তা টাকা নিয়ে কাজ করেন না কেন?’ লোকটার কথার ধরনই এরকম, সুযোগ তৈরী
করে মুনসি-মৌলবীদের ওপর এক চোট ঝাড়ে। তারা নাকি ধর্মের নামে ব্যবসা করে,
তাদের পয়সার খাঁই নাকি বেশী, তাদের দারুণ খাবার লোভ...।
কাঁচা-পাকা চুলের লোকটির কথা হয়তো সঠিক কিন্ত লেখক গল্পে বরিশাল তথা দেশের
সমসাময়িক আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারন শিক্ষার সাথে
দুর্নীতির চরম অবস্থা, অতি দরিদ্র মানুষের মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে হাসি-তামাশা
এবং সেই আলোকের অবগাহনে, বাস্তবতার আয়নায় ফুটিয়ে তুলেছেন একটি মৌলবী
পরিবারকে; চরম দরিদ্র অবস্থা কিভাবে আফাজ আলীকে মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে
শ্বশুরের সাথে নিজের ছেলের বাক-বিতন্ডার সময় নিরবতা পালন করতে বাধ্য করে।
আফাজ আলীর ছেলে হাবিবুল্লা দপদপিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করে বাকেরগঞ্জ
কলেজে ভর্তি হতে চাইলে নানা মওলানা আশরাফুদ্দিন উজীরপুরী তাতে জোর বাধা দেন,
‘অন্তত এলেম পর্যন্ত পড়, আল্লার এলেম বরকত দেয়।’ হাবিবুল্লা তর্ক করে,
মাদ্রাসা লাইনের ভবিষ্যৎ কি? গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়া ছেলেরা বাঁকা চোখে
তার দিকে তাকিয়ে হাসে; সে বলে, ‘আব্বাতো মৌলবী লাইনে পড়ে সংসার চালানো জন্য
পড়ে থাকে ঢাকার গোরস্তানে। সে আরো অকাট্য যুক্তি তুলে, মাইজা মামুরে তাইলে
মাদ্রাসা থাইকা ছাড়াইড়া লইলেন কেন? মাইজা মামু বেতন যা পাইবো, উপরি পাইবো
কম করিযা তার পাঁচগুন।' নানাও রাগিয়া বলে, চাকরির বাজার ভাল না, এম.এ, বিএ
পাশ করিয়া ছ্যামরাগুলো পথে পথে ঘুরতিয়াছে, চন্দ্র-সূর্য যতোদিন জ্বলবে,
মানুষের হায়াত মওতের আইন আল্লা যতদিন দুনিয়ায় রাখবে, মৌলবী ছাড়া মানুষের
চলবে না।
যাই হোক, কলেজ পরীক্ষায় হাবীবুল্লা একবার ফেল করে বোর্ড অফিসে ঘুষ দিয়ে
সেন্টার বদল করে। আবার কোন এক মাস্টারকে ঘুষ দিয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে।
চাকুরী জোটে না। শেষে, মনু মিয়াকে সাথে নিয়ে আফাজ আলী ২০০০ সাল নাগাদ সবার
জন্য শিক্ষা কর্মসুচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারী শিক্ষা বিস্তার প্রকল্প
অফিসের কোন এক অফিসারকে ৫০০০ টাকার ১ম কিস্তি ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষের টাকাটা
তিনি শর্তাধীনে ধার নিয়েছেন আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের কাছ থেকে।
শর্তানুযায়ী, চাকুরী হলে প্রথম মাসের বেতন আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারকে দিতে
হবে, বাকী টাকা শোধ হবে মাসে ৪০০ টাকা করে দিয়ে, এর উপর লাভ দিতে হবে ২০%
হারে, পরহেজগার মানুষ আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার, সুদ হারাম বলে লাভের অংশ
নেয়।(?!)
সংসার চালানো, ছেলের ঘুষের বাকী টাকা যোগার করতে আফাজ আলীকে সারাদিন কবরে
কাজ করতে হয়, ক্লাইন্ড এর শোককে উতরে দিয়ে রোজগার বাড়াতে হয়। এত কষ্টের
মধ্যে অন্য মুর্দ্দার মোনাজাতে নিজের ছেলের নাম অজান্তে চলে আসে, আঁতকে উঠে
তার মন। মোনাজাত শেষে ছেলের ভয়ানক অসুখের কথা সে শুনে। ছয় দিন পর শবে বরাত,
তারপরও সে চলে আসে বাকেরগজ্ঞে, রিকসাওয়ালার কাছে দাস্তে রোগে হাবিবুল্লার
মৃত্যু সংবাদ শুনে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে,
ইন্নালিল্লা বলার কথাও সে ভুলে যায়। নৌকায় পায়রা নদী পাড় হবার সময় তার
স্তম্বিত চেহেরা দেখে কেউ একজন বলে, হুজুর দোয়া দরূদ পড়েন। আফাজ আলী পায়রা
নদীর ঢেউ দেখে, ঢেউ গুলোকে তার কবর মনে হয়, হঠাৎ চমকে উঠে সে
আস্তাগফেরুল্লা পড়া অব্যাহত রাখে।
ছেলের কবর স্থানে গিয়ে সে আঁতকে উঠে, তুলনা করতে থাকে তার কর্মস্থল ঢাকার
অভিজাত গোরস্তানের সাথে এই গোরস্তানের। গল্পের ভাষায়, এই গোরস্তানের কি
ছিরি, এখানে দোয়া পড়ে আল্লার কালাম নাপাক করে ফেলা হয় না? এই কি গোরস্তান
না ভাগাড়? এ সব কি মুর্দাকে ইজ্জতের সঙ্গে দাফন করা, নাকি লাশ দড়ি বেঁধে
টেনে এনে পুঁতে রাখা হয়েছে? খালের ধারে বেত বন থেকে মানুষের ও বাঁশঝাড় থেকে
পর্দাশীন মেয়ে মানুষের গুয়ের গন্ধ, রাত্রে শেয়ালের খোঁড়া কবরগুলোর ভিতর
থেকে উঁকি দেওয়া বয়স, লিঙ্গ ও পেশা নির্বিশেষে মুর্দাদের খুচরা খাচরা
ঠ্যাং, রান বা হাঁটুর গন্ধ ...। মোনাজাতে তার মনে পড়ে আবদুল কুদ্দুসের ঋণের
টাকা...।
শ্বশুরের কাছ থেকে মাদ্রাসার ফান্ডের টাকা ধার করে সংসারে দিয়ে কিছু টাকা
নিয়ে সে শবে বরাতের দিন নিজের কর্মস্থলে চলে আসে। কবরগুলোকে গভীর তাজিমের
সাথে সালাম দেয় এবং নিরব জবাব তার কানে ভেসে আসে। তার সহকারী তার দায়িত্বে
থাকা কবরগুলিকে চিনা ঘাস, নানান ফুল গাছ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। আজ মুর্দাদের
বড় বড় আত্মীয়রা আসবে, তাদেরকে সে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেবে। আজ সে নিজেই
কঠিন শোকাহত। মুর্দা সন্তানের কবরের কাছে দাঁড়ানো শোকাহত পিতার সামনে
মোনাজাত করতে থাকে, “আল্লা, আল্লা রাব্বুল আলামিন, শাহতাব কবিরকে তুমি
বেহেস্তে নসিব করো। কিন্তু পাক পরওয়ারদিগার, তার বাপটারে কি তোমার নজরে পড়ল
না? বাপটা কি তামাম জীবন খালি গোরস্তানে গোরস্তানেই থাকবো?...আল্লা, তার
নাদান বাপটা কি খালি গোর জিয়ারত করার জন্যেই দুনিয়ায় বাচিয়া থাকবো।” আফাজ
আলী এবার সত্যি সত্যি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। অন্যের সন্তানের মোনাজাতে তার
নিজের সন্তানের লাশ তার সামনে চলে আসে। তার বঞ্চনার পদ ছাপে
স্বপ্ন-আশা-আকাঙখা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
কঠিন বাস্তবতার ছায়াপট তুলে ধরতে ক্ষুরধার লেখক আখতারুজ্জামান
মানুষ-কবর-ধর্ম-সামাজিক সংস্কার-অর্থনৈতিক বৈষম্য-সমাজে জোঁকের মত চেপে
বসা দুর্নীতি-সাধারন ও মাদ্রাসা শিক্ষা তথা দেশের বৈষম্যমূলক শিক্ষা
ব্যবস্থা, দৈন্যতা অতি নিঁখুতভাবে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে, এ যেন বর্তমান
সমাজের মিরর ইমেজ। লেখক তার সাহিত্যিকতার দিগন্ত ছাড়িয়ে মানবিক দায়বোধ থেকে
সাহিত্যকে সমাজের বাস্তবতার কাঠগড়ায় দাঁড় করেছেন। সমাজের মিথ্যা, সাজানো
নগ্ন চিত্রপটকে চোখের সামনে এনে সবাইকে যেন বলছেন, এটা সভ্যতা নয়, অসভ্যতা;
বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা কখনো, কোনদিন সমাজে স্বস্তি দিতে পারে না।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |